বিছানায় জাজিমের পরিবর্তে ম্যাট্রেসের ব্যবহার অনেকেরই পছন্দ। ম্যাট্রেসে ঘুমানো সাধারন তোষক বা জাজিমের থেকে অনেক আরামের, আর এই কারনেই ম্যাট্রেসের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার অনেকের কাছে সৌন্দর্যটাই মুখ্য। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ম্যাট্রেসের বিষয়ে আমরা এক প্রকার উদাসীনতাই দেখাই। আর এ কারণে তাতে ধুলা, ময়লা জমে খুব দ্রুত নোংরা হয়ে যায়। আর নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণে তৈরি হয় দুর্গন্ধ। যত্ন নেয়া না হলে এই ময়লা এবং দুর্গন্ধ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাতের কারন হয়ে দাঁড়ায়। এটি ধীরে ধীরে আপনাকে স্বাস্থ্যঝুকির মুখেও ফেলতে পারে, যা থেকে রক্ষা পেতে নিয়মিত ম্যাট্রেসের যত্ন নেয়া উচিত। এতে করে ম্যাট্রেসের লাইফস্প্যান যেমন বাড়বে, তেমনি রোজ রাতে আপনার ঘুমও হবে ভাল।
ম্যাট্রেসের যত্ন কেন নিব?
বিছানার ম্যাট্রেস নোংরা বেশি হয় এবং এটি ধোওয়া কিংবা পরিষ্কার করাও বেশ কঠিন। মুলত ঘাম, ত্বকের ডেড সেলস, চুল, খুশকি, শরীরে থাকা তেল এবং অন্যান্য নানান লিকুইড এলিমেন্টসগুলো বিছানায় জমতে জমতে এটাকে নোংরা করে ফেলে। এগুলোর পাশাপাশি বাহির থেকে আসা ধুলো বালি এবং ডাস্ট পার্টিকেলসও ম্যাট্রেস নোংরা হওয়ার জন্য দায়ী। তাই বিছানার চাদর ধোয়ার মত করে ম্যাট্রেসও নিয়মিত পরিষ্কার করা উচিত। পরিষ্কার ম্যাট্রেসে ঘুমানো আমাদের জন্য অনেকভাবেই বেনিফিশিয়াল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে –
এয়ার কোয়ালিটি বৃদ্ধি
ম্যাট্রেস নোংরা হলে এটি আপনার বেডরুম তথা পুরো বাসাতেই গুমোট এবং গন্ধযুক্ত বাতাসের সৃষ্টি করে। এর পাশাপাশি আপনি যখন ঘুমোতে যান, এই গন্ধ আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। তাই, ম্যাট্রেসের নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষন করলে এটি আপনার বাসার ভেতরের বাতাসকে নষ্ট করেনা এবং আপনাকে সাউন্ড স্লিপ নিতে সাহায্য করে।
অ্যালার্জির ঝুঁকি কমায়
নোংরা ম্যাট্রেসের ডাস্ট এবং ব্যাকটেরিয়ার কারনে আপনার রাতের ঘুম অস্বস্তিকর হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, অপরিষ্কার ম্যাট্রেস ব্যবহারের কারনে আপনার স্কিনে র্যাশ, ব্রণ এবং হাচি-কাশির মত রোগে ভুগায়। তাই নিয়মিত পরিষ্কার ম্যাট্রেস ব্যবহারে এসকল সমস্যা থেকে সহজেই সমাধান পাওয়া যায়।
বেড বাগস থেকে সুরক্ষা
অপরিষ্কার বিছানায় খুব সহজেই বেড বাগস আক্রমন করে এবং এগুলোর আক্রমনে আপনাকে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত ভুগতে হতে পারে। ময়লা এবং তেল চিটচিটে বিছানায় বেড বাগস সহজেই আক্রমন করে, তাই এগুলো থেকে মুক্তি পেতে পরিষ্কার বিছানার বিকল্প নেই।
লাইফস্প্যান বাড়ানো
অযত্নে রাখা জিনিস বেশিদিন টেকেনা এটা আমরা সবাই জানি। সাধারন জাজিমের চেয়ে ম্যাট্রেসের মুল্য বেশ খানিকটা বেশি, তাই এটি যেন দীর্ঘসময় ব্যবহার করা যায়, সেটাই সবাই চাই। কিন্তু যদি ঠিকভাবে পরিষ্কার পরিছন্ন করেই ব্যবহার না করা যায়, তাহলে এমনিতেই ম্যাট্রেস বেশিদিন টিকবে না। তাই লাইফস্প্যান ঠিক রাখার জন্যও নিয়মিত এটাকে পরিষ্কার রাখা জরুরি।
কিভাবে ম্যাট্রেসের যত্ন নিব?
যেহেতু সুস্থ এবং স্বাভাবিক ঘুমের জন্য পরিষ্কার ম্যাট্রেস বিশাল ভুমিকা পালন করে, তাই নিয়মিত ম্যাট্রেসের যত্ন নেয়া অনেক জরুরী। এমনিতে নিয়মিতই যেহেতু ম্যাট্রেস পরিষ্কার করতে হবে সেটি নিয়ে আমরা নিচে আলোচনা করবো। এছাড়াও, অনেকসময় অনাকাঙ্খিত অনেক কারনে ম্যাট্রেস নোংরা হয় যেমন – শিশুদের মল মুত্র, বমি, কফি – ওয়াইন, রক্ত, ইত্যাদির দাগও কিভাবে ম্যাট্রেস থেকে তোলা যায় সেই বিষয় নিয়েও আলোচনা করব।
ম্যাট্রেসের নিয়মিত পরিষ্কারের নিয়ম
আজকাল ম্যাট্রেসের ভিতর নানাধরনের কেমিক্যাল দেওয়া হয় ফলে এতে যেমন ধুলোমাটি জমতে পারে না তেমনি পোকামাকড় হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। এছাড়াও, পানি এবং ময়েশ্চার থেকে ম্যাট্রেসকে বাঁচাতে ওয়াটারপ্রুফ ম্যাট্রেস প্রোটেকটর পরিয়ে রাখুন।
মাসে একবার কিংবা দুইবার ম্যাট্রেসে ওপর- নিচে এবং চার পাশের অংশ ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করুন।
ভ্যাকিউয়ামের পাশাপাশি, ১ কাপ বেকিং সোডার সাথে কয়েক ফোটা এসেনশিয়াল ল্যাভেন্ডার ওয়েল মিশিয়ে সেই বেকিং সোডা পুরো ম্যাট্রেসের উপর ছড়িয়ে দিন। কিছুক্ষন রেখে আবার ভ্যাকিউম দিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
প্রতিটি ম্যাট্রেসের সঙ্গে কোম্পানির ওয়ারেন্টি দেওয়া থাকে। ওয়ারেন্টির সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার ২ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত ম্যাট্রেস ভালো থাকে। ম্যাট্রেসের মধ্যেখানটা গর্ত হয়ে গেলে, সেটা বদলে ফেলাই বাঞ্ছনীয়।
ম্যাট্রেস থেকে বিভিন্ন দাগ কিভাবে পরিষ্কার করবো?
ম্যাট্রেস ব্যবহার করতে গেলে এর উপর নানা জিনিসের দাগ-ছোপ পড়তে পারে। সাধারনত চাদর থাকলেও, কঠিন দাগগুলো চাদর ভেদ করে সরাসরি ম্যাট্রেসে আক্রমন করে।
প্রস্রাব ও ঘামের দাগঃ বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকলে বিছানায় প্রস্রাব করেই থাকে। আবার গরম কালে ঘামের ফলে বিছানার গদিতে হলুদ দাগ-ছোপ দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এই দুই কারণে বিছানা থেকে দুর্গন্ধ তো বের হয়েই, পাশাপাশি গদির রঙও হতে থাকে মলিন। এই ধরনের দাম থেকে মুক্তি পেতে –
একটি কাপে ৩ শতাংশ হাইড্রোজেন পারওক্সাইড, ৩ টেবিল চামচ বেকিং সোডা এবং কয়েক ফোটা লিকুইড ডিশ ওয়াশিং সোপ একত্রে মিশিয়ে নিন। এরপর ম্যাট্রেসের যেখানে এধরনের দান আছে সেখানে স্প্রে করুন এবং ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পর ব্লোয়ার বা ড্রায়ার দিয়ে শুনিয়ে নিন। দেখবেন দাগ চলে গেছে।
রক্তের দাগঃ অনেক সময় বিছানাতে মৃত মশা সহ নানা কারনেই রক্ত লেগে থাকতে পারে। রক্তের দাগ তুলতে, একটি স্প্রে বোতলে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মিশ্রন নিন। এরপর যেখানে রক্তের দাগ রয়েছে সেখানে ভালভাবে স্প্রে করুন এবং পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে পরিষ্কার করুন। যতক্ষন না পরিষ্কার হচ্ছে, ততক্ষন এভাবেই চালিয়ে যান, এবং সব দাগ উঠে গেলে ম্যাট্রেস শুকিয়ে নিন।
বমির দাগঃ ছোট শিশু কিংবা অসুস্থ ব্যাক্তিরা অনেক সময় বিছানাতেই বমি করে দেন। সেই দাগ পরিষ্কার করতে অর্ধেক পানি এবং অর্ধেক সাদা ভিনিগার মিশিয়ে একটি স্প্রে বোতলে ভরে নিন। এরপর দাগের অংশে স্প্রে করুন, এবং সাদা তোয়ালে বা রুমাল দিয়ে মুছতে থাকুন। দাগ দূর হবার পর বেকিং সোডা ছিটিয়ে দিন। ঘন্টা খানেক পর ভ্যাকিউম দিয়ে পরিষ্কার করে নিন।
কফির দাগঃ তরল সাবানের সাহায্যে ঘষে ঘষে কফির দাগ পরিষ্কার করতে পারেন। তবে এই দাগ পুরনো হলে স্যালাইন মিশ্রিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন। তার পর ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিন।
ম্যাট্রেসের লাইফস্প্যান বাড়ানোর জন্য টিপস
ম্যাট্রেসের উপর অবশ্যই কভার ব্যবহার করুন। এতে করে ম্যাট্রেসে ময়শ্চার এট্যাক করতে পারবে না এবং ম্যাট্রেসে ফাঙ্গাস পড়বে না। অন্তত ৩ মাস পর পর ম্যাট্রেসের ফুল সাইকেল ক্লিনিং করা উচিত। যদি সময় না পান, তাহলে ম্যাক্সিমাম ৬ মাস পর পর করতেই হবে। কোন দাগ দেখলে সাথে সাথে উপরে উল্লেখিত উপায়ে পরিষ্কার করতে হবে। এছাড়াও, প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর ম্যাট্রেসের সাইড চেঞ্জ করুন।
ম্যাট্রেস ৩ মাস পর পর পরিষ্কার করলেও বিছানার চাদর কয়েকদিন পর পরই পরিষ্কার করা উচিত। এতে করে স্কিনের ডেড সেলস এবং চাদরে জমে থাকা ঘাম আর আপনার ত্বকের ক্ষতি করতে পারবে না।
ম্যাট্রেস পরিষ্কার করতে HEPA ফিল্টার সংবলিত ভ্যাকিউম ক্লিনার ব্যবহার করুন। এতে করে ম্যাট্রেস থেকে সব ধুলো-বালি এবং ডাস্ট পার্টিকেল পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়াও, ম্যাট্রেস থেকে যে কোন বাজে দুর্গন্ধ দূর করতে বেকিং সোডা ব্যবহার করুন। এসকল কাজের মাধ্যমে আপনি সহজেই ম্যাট্রেসের লাইফস্প্যান বৃদ্ধি করতে পারবেন।
সারকথা
সুস্থ ও স্বস্তিদায়ক ঘুমের জন্য পরিষ্কার ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা ম্যাট্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে শুধুমাত্র আপনার ঘুমের মান উন্নত হয় না, বরং অ্যালার্জি, দুর্গন্ধ, বেডবাগসের ঝুঁকি এবং স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। পরিষ্কার ম্যাট্রেস মানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবহার। তাই, মাসে অন্তত একবার ম্যাট্রেস পরিষ্কার রাখা, সঠিকভাবে কভার ব্যবহার করা এবং সময়মতো দাগ দূর করা এই সব কাজের মধ্য দিয়ে আপনি আপনার ম্যাট্রেস যেমন অক্ষত রাখতে পারবেন, তেমনি পাবেন প্রশান্তিদায়ক ঘুমের নিশ্চয়তা। মনে রাখবেন, ভালো ঘুমের জন্য একটি ভালো ম্যাট্রেসের বিকল্প নেই। আর সেই ম্যাট্রেস ভালো রাখার দায়িত্ব আপনারই।
ম্যাট্রেস পরিষ্কার সংক্রান্ত সাধারণ প্রশ্নোত্তর
ম্যাট্রেস কতদিন পরপর পরিষ্কার করা উচিত?
ম্যাট্রেস পরিষ্কারে আপনি যতই নিয়মিত হবেন তত ভালো ফলাফল পাবেন। মাসে অন্ততঃ একবার আপনার ম্যাট্রেসটির পরিচর্যা করা উচিৎ। প্রতি তিন মাস অন্তর পরিপূর্ণ ক্লিনিং এবং প্রয়োজনীয় রিপেয়ার করলে আপনার ম্যাট্রেসটি নতুনের মতই সার্ভিস দিয়ে যাবে।
ম্যাট্রেস পরিষ্কার করতে কোন ধরনের ভ্যাকিউম ক্লিনার সবচেয়ে উপযোগী?
HEPA ফিল্টারযুক্ত ভ্যাকিউম ক্লিনার ম্যাট্রেস পরিষ্কারে সবচেয়ে কার্যকর। কারণ এটি ধুলাবালি, অ্যালার্জেন এবং ক্ষতিকর কণাগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে এবং আপনার রোগ-ব্যাধী হবার আশংকা কমায়।
বাচ্চা প্রস্রাব করলে ম্যাট্রেস থেকে দুর্গন্ধ ও দাগ কীভাবে তুলব?
তিন শতাংশ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, বেকিং সোডা ও লিকুইড ডিশ সোপ একত্রে মিশিয়ে দাগের জায়গায় স্প্রে করুন। কিছুক্ষণ রেখে পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলুন এবং শুকিয়ে নিন।
প্রতিদিন কি ম্যাট্রেস পরিষ্কার করা প্রয়োজন
প্রতিদিন পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই তবে চাদর ঝেড়ে দেওয়া, ঘর হাওয়া খোলা রাখা এবং চাদর নিয়মিত ধোয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাট্রেসে কভার ব্যবহার করা কি জরুরি?
ম্যাট্রেসে কাভার ব্যবহার করলে সেটি ঘাম, তেল, ধুলা ও দাগ থেকে রক্ষা পায়। শিশুদের বিছানায় ব্যবহৃত ম্যাট্রেসে পানিনিরোধক কাভার ব্যবহারে প্রস্রাব অথবা বেখেয়ালে ছলকে পড়া পানি ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।