একদিকে পাখি ডাকা ভোরের শুরু, অন্যদিকে আহসান সাহেব চোখ খুলে তাকালেন। ঘরের সিলিং-এ ফ্যান ঘুরছে মাঝারি গতিতে। প্রশান্তির ঘুম দিয়ে ওঠা একটি সকাল। জানালা দিয়ে দিনের আলো অল্প অল্প করে ঘরে উঁকি দিচ্ছে, এ যেন আলো-ছায়ার দারুণ এক খেলা। আহসান সাহেব ঘুম থেকে উঠে পাশের টেবিলে রাখা চশমাটি পড়ে নিলেন। ভোরের এই মায়ামাখা রোদের দারুণ এক শক্তি। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠে জেতেই হয়, মনে মনে এমনটাই তিনি ভাবছিলেন।
ধীর পায়ে বারান্দায় রাখা আর্ম চেয়ারে তিনি বসলেন। সকালের এই স্নিগ্ধ, সুন্দর মুহূর্ত তাকে বেশ শান্তি দেয়, মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার স্কুলে যাওয়ার সে সময়ের কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই পাশে রাখা টেবিল থেকে পত্রিকাটা হাতে নিবেন, ঠিক এমন সময় ‘দাদুভাই’ বলে ছোট্ট একটি মেয়ে দৌড়ে আসলো। স্কুলের ড্রেস পরে সে একদম তৈরি, দাদুকে দেখাচ্ছে তার নতুন স্কুলের ব্যাগ-জুতো-জামা। আর ঠিক তার পেছনেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো তার আদরের ছোট্ট ভাই। বোনের সাথে সেও যে এখন স্কুলে যাবে! তা দেখে আহসান সাহেবও মুচকি হেসে দিলেন।
এদিকে রৌদ্র আর হিমি, দু’জনের সংসারের শুরুটা এইতো মাত্র কয়েকদিনের। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে যার যার ব্যস্ততা শুরু হলেও, ছুটির দিনের সকালটা কিন্তু অন্যরকম সুন্দর। চা-প্রেমী দু’জনার সকালের শুরুটাই হয় রৌদ্রের বানানো এক কাপ চা হাতে রকিং চেয়ারে বসে। রৌদ্র ভীষণ মজার চা বানাতে পারে। আর হিমিরও যে বিশেষ সেই চা দারুণ পছন্দের। ছোট ছোট অসংখ্য গল্পে আর দখিনের ব্যালকনিতে রাখা ফুলের গাছগুলোর সাথে এভাবেই শুরু হয় তাদের ছুটির দিনের সকালটা।
অদিতি আর রিদিতা দুই বোন। বয়সের পার্থক্য একটু বেশি হলেও, দু’জনের মধ্যকার বন্ডিংটা বেশ স্ট্রং। বিশেষ করে রিদিতা, বয়সে ছোট হলেও আপুনি-কে সে যেন খুব ভালো বুঝতে পারে। কখন সে কী ভাবছে, জন্মদিনে তার জন্য বেস্ট সারপ্রাইজ কী হবে, গাছদের ব্যাপারে আরেকটু বেশি যত্নশীল হওয়া, এমন অনেক কিছু নিয়েই রিদিতা বরাবরই বেশ দায়িত্ববান ছোটবোন। ওদিকে অদিতি ছোটজনের ব্যাপারে বেশ প্রোটেক্টিভ আর সিরিয়াস। আর তাই তো বিয়ের দিন অদিতি বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, “আমাকে কি একটুও মিস করবি না?” বেডসাইড টেবিলে রাখা দু’জনের সেই মিষ্টি হাসির ফটোফ্রেমটা হাতে নিয়ে রিদিতা বলে উঠেছিলো, “তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো? এই যে, তুমি তো এখানেই আছো!”
মিসেস রিজওয়ানা, রান্নাবান্না তার ভীষণ পছন্দ। আর সে সাথে ঘর গোছানো। ঘরের প্রতিটি কাজের ব্যাপারে দারুণ শৌখিন তিনি, সাথে যেকোনো অনুষ্ঠান কিংবা অতিথি আপ্যায়নে, ডাইনিং টেবিল জুড়ে থাকে তার বানানো মজার সব খাবার। আর হ্যাঁ, সেলাই এর কাজে তার মন যেন হারিয়ে যায় ভিন্ন কোন জগতে। আদুরে নাতি-নাতনিদের কাছে তিনি তো রীতিমতো আর্টিস্ট। আর এ কারণেই, ছুটোছুটি আর খেলাধুলার ফাঁকে, দীদার কাছে চলে এটা-সেটা বানিয়ে দেওয়ার কতশত আবদার। এদিকে দীদাও ব্যস্ত হয়ে পড়েন লিভিং রুমের সোফায় বসে ছোট ছোট সে সকল আবদার পূরণ করতে।
অন্যদিকে, তুর্য আর তিথির মান-অভিমানের গল্পটা যেন সব কিছুকেই হার মানিয়ে যায়। এই রোদ, তো এই বৃষ্টি। প্রকৃতির সাথে তাদের মনের আবহাওয়াও যে কখন পাল্টে যায় বোঝাই মুশকিল। তবে, মনের মতো অফিস ডেস্ক পেয়ে তুর্য কিন্তু সেদিন তার সব রাগ এক নিমিষেই ভুলে গিয়েছিল। আর তিথির পছন্দ আয়না। বেডের সাথে মিল রেখে তুর্যও তিথির জন্য বিশাল বড় এক উপহার নিয়ে এলো ঘরে। ড্রেসিং টেবিল দেখে তিথি তো এদিকে খুশির কান্নাই জুড়ে দিলো! মান-অভিমানের সে মেঘ যে কখন কেটে গেল, দু’জনের একজনও বলতে পারবে না। তবে ভালোবাসার গল্পে মান-অভিমান না হলে কি আর গল্প জমে ওঠে?
বাড়ি, সে অদ্ভুত অনুভূতির জায়গা। যেখানে অনুভূতিগুলো মিলেমিশে যায়, একেক সময় একেক পরিচয়ে। কখনো অবসরের দিন হয়ে, কখনো নতুন করে সংসার শুরুর মুহূর্ত হয়ে, ঘর জুড়ে দুই বোনের দারুণ সব স্মৃতি, অতিথি আপ্যায়নে আনন্দ, কিংবা মান-অভিমানের সংজ্ঞায়; প্রতিদিনের ছোট ছোট বিশেষ এই মুহূর্তগুলোই তৈরী করে জীবনের গল্প। এ যেন একদমই ভিন্ন এক অনুভূতি। আর এ সকল অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাই হয়ে ওঠে আমাদের প্রতিদিনের পথচলার অনুপ্রেরণা।