সৌন্দর্য বরাবরই মানুষের নান্দনিক আনন্দের ধারক হিসেবে পরিচিত হয়ে এসেছে কারন সকলেই ছিম-ছাম গোছানো জিনিস পছন্দ করে। আবার এই সৌন্দর্যের সাথে রুচিবোধের মিশেলের মাধ্যমে মানুষ সৌখিন হয়ে উঠে। যদিও সৌখিন বলতে আমরা ব্যাক্তির পরিপাটি থাকা এবং তার বাহ্যিক অবস্থাকে বোঝাই, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে একজন সৈখিন ব্যাক্তি নিজের পাশাপাশি তার আশে পাশের পরিবেশ ও বাসস্থানকেও নান্দনিক ভাবে সাজাতে পছন্দ করে। বাসস্থান সাজানোর ক্ষেত্রে প্রায় সকলের আগ্রহ থাকে শোবার ঘর, খাবার ঘর কিংবা বসার ঘরের প্রতি, কিন্তু বাসার আরেকটি গুরুত্বপুর্ন অংশ – রান্নাঘরের প্রতি মানুষের তেমন খেয়াল থাকেনা বললেই চলে। বলা বাহুল্য যে, একটি গৃহের মধ্যে অন্যান্য রুমের চাইতে রান্নাঘর কোন অংশেই কম গুরুত্বপুর্ন অংশ নয়। রান্নাঘর কে বাড়ির যতটা অবহেলিত জায়গা মনে করা হয়, বিষয়টি একদমই তা নয় বরং সাজানোর বা ডেকোরেশন এর জন্য সবার আগে সকলের রান্নাঘরের কথাই বিবেচনা করা উচিত। যেহেতু আমাদের বাড়ির গৃহিণীরা দিনের অধিকাংশ সময় রান্নাঘরে কাটিয়ে দেয়, এই বিবেচনাবোধ থেকে হলেও আমাদের উচিত রান্নাঘর কে তাদের জন্য আরামদায়ক ও সুন্দরভাবে ভাবে সজ্জিত করা দেয়া।
আধুনিক রান্নাঘর সাজানোর ১০ টি উপায়
বর্তমান সময়ে রান্নাঘর ডেকোরেশন করা নিয়ে অনেকে তৎপর হলেও, বেশিরভার মানুষই ভাবেন যে রান্নাঘর সাজাতে অনেক বড় অংকের টাকা ব্যয় করতে হয়। কিন্তু, বাস্তবিকতা হলো, খুব সাশ্রয়ী বাজেটের মধ্যে আধুনিক ডিজাইনের রান্নাঘর সাজানো সম্ভব যা আপনার রান্নাঘরকে দুর্দান্ত সুন্দর করে তুলবে।
রান্নাঘরের লে আউট
রান্নাঘরের পরিবেশ মুলত জায়গার উপর নির্ভর করে। ছোট রান্নাঘরের জন্য প্যারালাল শেইপ বেশ মানানসই। তবে রান্নাঘর যদি বড় হয়, তাহলে তা ইংরেজি ইউ (U) অথবা এল (L) শেইপে রাখলে ভাল হবে। এতে হাটাচলার যথেস্ট স্পেস পাওয়া যাবে এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুসারে কাজও করা যাবে। লে আউট প্ল্যানিংয়ের সময় রান্নাঘরে বড় একটি জানালার থাকা অবশ্যক , কেননা বাংলাদেশ একটি গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। রান্নাঘরে যেহেতু আগুনের সাহায্যেই রান্নাবান্না করা হয় তাই এই রুমে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হবে এই স্বাভাবিক। আর এই তাপ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বড় জানালা খুবই গুরুত্বপুর্ন। তবে রান্নাঘরের স্থান স্বল্পতা কারনে বড় জানালা ব্যবহার করা না গেলে, ছোট একটি ফ্যান এবং সাথে একটি এগজস্ট ফ্যান ব্যবহার করতে পারেন। এতে রান্নাঘরে বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি রান্নাঘরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও সাবলীল হতে হবে।
রান্নাঘরের চিমনি
তেল মশলা মিশ্রিত রান্নার ধরনের কারনে আমাদের রান্নাঘরের দেয়ালে ও সিলিংয়ে তেল চিটচিটে ভাব বেশি থাকে। আবার এই কারনে রান্নাঘরে ধোঁয়া ও গন্ধ—দুটিই বেশি হয়। তাই মসলার গন্ধ হোক বা তেল চিটচিটে ভাব—দুটি কমাতেই স্মার্ট রান্নাঘরে রাখা চাই কিচেন হুড বা চিমনি। আধুনিক সময়ে রান্নাঘরের জন্য তৈরি করা হচ্ছে নানা নকশার স্টাইলিশ চিমনি। এমন চিমনিতে তাই রান্নাঘরের সৌন্দর্যও বাড়ে। সঙ্গে রান্নাঘরে তৈরি হয় স্বস্তিকর পরিবেশ। বৈদ্যুতিক চিমনি বাজারে এখন বেশ জনপ্রিয়। এ ধরনের চিমনি ধোঁয়া ও তাপ টেনে নেয়। আধুনিক এই চিমনিতে থাকে এয়ার পিউরিফায়ার ও ফ্যান। বিদ্যুৎ বিলও আসে কম। মাঝারি আকারের চিমনি রান্নাঘরের কাউন্টার ছাদেও সহজে বসানো যায়।
রান্নাঘরের ক্যাবিনেট
বাংলাদেশে কিচেন ক্যাবিনেটের ব্যবহার করাটা এখনো বেশ নতুন একটা কনসেপ্ট। আজ থেকে ৫/৭ বছর আগেও মানুষজন বাড়ি তৈরির সময় রান্নাঘরে “তাক” এর ব্যবস্থা করত এবং সেই তাকের উপরই রান্নার সক তৈজসপত্র রাখত। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষের রুচিবোধের ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে এবং এই পরিবর্তনের ধারার সাথেই ক্যাবিনেটের মাধ্যমে রান্নাঘরের তাক প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। রান্নাঘরে ক্যাবিনেটের মধ্যে সহজেই প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা যায়, এবং আলাদা করে কিচেন র্যাক ব্যবহারের দরকার পড়েনা বলে অনেকখানি জায়গা সাশ্রয় হয়। আপনি চাইলে আপনার বাসার জন্য কাস্টমাইজড ক্যাবিনেট তৈরী করে নিতে পারেন, যেখানে আপনার চাহিদা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির জন্য আলাদা সেকশন থাকবে। এছাড়া, হাতিলে রয়েছে মডিউল্যার কিচেন যেখান থেকে আপনি আপনার পছন্দ অনুসারে যেকোন কিচেন ক্যাবিনেট স্টাইল সিলেক্ট করতে পারেন।
রান্নাঘরের দেয়াল
রান্নাঘরের দেয়াল হওয়া উচিত উজ্জ্বল রঙের। তাই উপরের সিলিং এবং পাশের দেয়ালে এমন রঙ ব্যবহার করা উচিত যা আলোর প্রতিফলন ঘটায়। ডেকোরেশনের ক্ষেত্রে কালার স্কিমের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে, তাই আপনি চাইলে তিনটি রঙের সমন্বয়ে একটি প্যালেট ব্যবহার করতে পারেন। আবার রান্নাঘরের যদি দেয়াল ফাকা থাকে তবে সেখানে বিভিন্ন শোপিস প্লেট কিংবা কাচের ঢাকনি ব্যবহার করে কিচেন ওয়ালটিকে সাজিয়ে তুলতে পারেন। এতে করে আপনার সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এবং আপনার রান্নাঘর অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুসজ্জিত বলে মনে হবে।
রান্নাঘরের মেঝে
রান্নাঘরের জন্য আইডিয়াল ফ্লোরিং ম্যাটেরিয়াল হলো সিরামিকের টাইলস। কারন এতে দাগ লাগলে খুব সহজেই পরিষ্কার করা যায়। এমনকি মেঝেটি দেখতেও খুব চকচকে লাগে। যারা সিরামিকের টাইলস ব্যবহার করতে পারবে না তাদের জন্য বিকল্প হিসেবে বর্তমানে বাজারে বেশ কিছু ডিজাইনের ফ্লোর কভার পাওয়া যাচ্ছে এটিও বেশ চমৎকার কাজে আসে। আপনি যদি মেঝেতে চীনামাটির বাসন অর্থাৎ পোর্সেলিন স্টোনের কার্পেট ব্যবহার করেন তবে পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকগুণ কম সময় লাগবে।
রান্নাঘরের লাইটিং
সাধারনত একটি ফ্ল্যাটের মাঝামাঝির দিকেই রান্নাঘর অবস্থিত হয়ে থাকে, তাই আশে পাশে খোলা মেলা না থাকার কারনে এই ঘরে আলোর ব্যবহার কম থাকে। আলোর উৎস হিসেবে অনেকে এক বা একাধিক লাইট ব্যবহার করে থাকেন, তবে, অনেক ক্ষেত্রেই তা অপ্রতুল হিসেবে পরিগনিত হয়।তাই রান্নাঘর সাজানো পরিকল্পনায় সঠিক বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন। এছাড়াও কেবিনেট এর নিচে অথবা সিলিং এর অংশের লাইটিং করে সাজাতে পারেন, বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন ডিজাইনের ঝাড়বাতি বা পেন্ডেন্ট লাইট পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ও ব্যবহার করতে পারেন। আলোকসজ্জা আপনার রান্নাঘরে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দেবে।
রান্নাঘরের ফার্নিচার
রান্নাঘরে আসবাবপত্র হওয়া উচিত প্রয়োজনমাফিক এবং যুক্তিসংগত, অর্থাৎ যা না হলেই নয় এ ধরনের আসবাব দিয়ে রান্নাঘর সাজানো উচিত, অতিরিক্ত আসবাবপত্রের কারণে রান্নাঘরকে অগোছালো দেখাতে পারে, এবং অনেক জায়গা ও এতে নষ্ট হয় ফলে চলাচলের অসুবিধা সৃষ্টি হয়। আসবাবপত্র রান্নাঘরে যত কম হবে, রান্নাঘরটি তত খোলামেলা থাকবে। চাইলে আপনার রান্না ঘরে সাদা রংয়ের আসবাবপত্র ব্যবহার করতে পারেন সাদা হল একটি ভিজ্যুয়াল স্পেস এক্সপেন্ডার যা আপনার রান্নাঘরকে আরও উজ্জ্বল এবং আরও শৌখিন করে তুলবে।
রান্নাঘরের স্টোরেজ
শুকনো ইনস্ট্যান্ট খাবার বা স্নাক্স রাখার জন্য আলাদা ড্রয়ার তৈরি করতে পারেন। বিস্কুট, নুডুলস, চিপস, বা যে কোন স্নাক্স প্রায়শই অগোছালো অবস্থায় থাকে। আবার অনেক সময় খুঁজে পেতে সমস্যা হয়, তাই স্টোরেজের জন্য আলাদা জায়গা থাকলে জিনিসগুলো গোছানো থাকবে এবং সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যাবে।
রান্নাঘরের সাজসজ্জা
রান্নাঘরের সাজসজ্জায় পার্সোনাল টাচের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। যেমন রান্নাঘরে পেইন্টিং, বিভিন্ন ইনডোর প্ল্যান্ট, ইত্যাদি লাগাতে পারেন। আবার চাইলে রান্নাঘরে কফি মগ এবং শোপিস সাজিয়ে রাখার জন্য খোলা তাক ব্যবহার করতে পারেন। অবশ্য অনেকের ধারনা মতে, খোলা তাকগুলোতে জিনিসপত্র রাখলে সেগুলো সহজেই এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। কিন্তু আপনি যদি সুন্দর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে পারেন, এটি হতে পারে আপনার রান্নাঘরের অন্যতম আকর্ষন।
রান্নাঘরের কাজের স্থান
আমাদের দেশের হোমমেকাররা প্রায় সারাদিনই রান্নাঘরে অতিবাহিত করেন। পুরো রান্নাঘর ঘুরে ঘুরে কাজ করতে তারা একদিকে যেমন দিন শেষে ক্লান্তিও অনুভব করেন, আবার অন্যদিকে পরিষ্কার করার ঝামেলাও এতে বেড়ে যায়। এই ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য আপনার রান্নাঘরে একটি নির্দিষ্ট অংশ রাখতে পারেন যেখানে রান্না ঘরের যাবতীয় কাজ যেমন সবজি, মাছ কাটা বা বাছার কাজ করা যাবে। চেস্টা করবেন এই জায়গাটা যেন কিচেন সিংকের পাশে হয় তাহলে সহজেই ধোয়ার কাজও করতে পারবেন। এই কাজের স্থান রান্নাঘরের একটা কোনার দিকে রাখার চেস্টা করুন, তা না হলে কাজ করার সময় ময়লা পুরো রান্নাঘরেই ছড়িয়ে যেতে পারে।
আপনার রান্নাঘরের ডিজাইন পরিকল্পনা করার সময় এই সামগ্রিক বিষয়গুলো মাথায় রেখে তারপর ডিজাইনিং করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। খেয়াল রাখবেন, রান্নাঘর ছোট হোক কিংবা বড়, সব কিছু সাজানো গুছানো রাখলে পুরো রান্নাঘর জুড়ে সব কিছুর মধ্যেই সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটানো সম্ভব। পরিপাটি, ছিমছাম এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এর সুব্যবস্থা আছে এমন একটি রান্নাঘর দেখতে ও ভীষণ নান্দনিক লাগে। তাই দেরি না করে সাশ্রয়ী বাজেটে নতুন করে সাজিয়ে তুলুন আপনার বাড়ির রান্নাঘরটা। নিজের সৌখিনতা ও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটান সৌন্দর্যের বিকাশের মাধ্যমে।