কমপক্ষে ১৪ দিন। কিংবা হতে পারে আরো বেশি। করোনায় আক্রান্ত হলে একদম একা ঘরবন্দী থাকতে হয় লম্বা সময়, যা যেকোনো মানুষের জন্যই সহ্য করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
আর এই স্বেচ্ছাবন্দিত্বের সময়টাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘কোয়ারেন্টিন স্পেস’।
বাংলাদেশে এই ধারণা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে যাতে নতুন করে ঝামেলার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়, সেই চিন্তা থেকেই এখন অনেকেই বাসার কোণে একটি ছিমছাম কোয়ারেন্টিন স্পেস গুছিয়ে রাখার কথা ভাবছেন।
এ ছাড়া এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে কিছুদিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়, যে কারণে আরো দরকারি হয়ে উঠেছে কোয়ারেন্টিন স্পেসের এই ধারণা।
বাসা কিংবা রুমের আকার-আকৃতি মাথায় রেখেই একটি কোয়ারেন্টিন স্পেস সাজানো দরকার। কীভাবে সাজাতে পারেন কোয়ারেন্টিন স্পেস, সে ব্যাপারে কিছু টিপস নিয়েই আজকে আমাদের এই ব্লগ।
রোগীর আরাম নিশ্চিত করাই মূল উদ্দেশ্য
যেকোনো কোয়ারেন্টিন স্পেস কিংবা রিকভারি রুম বানানোর মূল উদ্দেশ্যই হলো রোগীর কষ্ট যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। পুরো রুমে এমন কিছু রাখা যাবে না, যেটা রোগীর শারীরিক কিংবা মানসিক কষ্ট বাড়িয়ে তুলবে।
এমনকি বিছানার চাদর, পর্দা, ফ্লোর ম্যাট কোন ফেব্রিক এবং কোন রঙের হবে, সেটাও সাবধানে পছন্দ করতে হবে। বিছানার চাদরের ক্ষেত্রে রোগীর জন্য আরামদায়ক এবং ত্বকবান্ধব হবে, এমন ফেব্রিকই বেছে নেওয়া ভালো। সে ক্ষেত্রে সুতি কিংবা লিনেন কাপড়ের চাদর হয়ে উঠতে পারে ভালো সমাধান।
বিছানার চাদর কিংবা ঘরের পর্দা কোন রঙের হবে, সেটা বেছে নেওয়ার সময় রোগীর পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয়। তবে কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষটির মানসিক প্রশান্তির কথা ভেবে সাধারণত এই ক্ষেত্রে হালকা রংগুলোকেই বেছে নিতে বলা হয়। রোগীর মানসিক প্রশান্তির জন্য তার পছন্দ অনুযায়ী রুমের দেয়ালে ছবি কিংবা চিত্রকর্মও ঝোলানো যেতে পারে।
যথেষ্ট আলো-বাতাস প্রয়োজন
কোয়ারেন্টিন স্পেসে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্ধকারে মানুষের শরীরে মেলাটোনিন নামের একটি হরমোন তৈরি হয়, যেটা ঘুমের জন্য প্রয়োজন। করোনায় আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই।
তবে স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোর মতো টিমটিমে আলো এই হরমোন তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই এ ধরনের আলো যাতে না ঢোকে, সেই ব্যাপারটি নিশ্চিত করা দরকার। সবচেয়ে ভালো হয় রাতে ঘুমের সময় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নিশ্চিত করতে পারলে।
তবে সকালের আলো আবার রোগীর জন্য খুব দরকারি। তাই সকালে উঠেই পর্দা সরিয়ে দেওয়া দরকার, যাতে পর্যাপ্ত রোদ ঘরে ঢুকতে পারে। এতে রোগীর শরীরে সেরোটোনিন নামের আরেকটি হরমোন তৈরি হবে, যা সুস্থ হওয়ার জন্য প্রয়োজন।
কোয়ারেন্টিন স্পেসে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থাও থাকা দরকার। আমাদের শরীর সাধারণত নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে এখানেও রোগীর আরামের ব্যাপারটাই আগে প্রাধান্য পাবে। তার চাহিদা অনুযায়ী রুমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো হয়।
রোগীর সুবিধার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ফার্নিচার
রোগীর প্রয়োজন মেটাতে দরকারি সব ধরনের ফার্নিচার একটি আদর্শ কোয়ারেন্টিন স্পেসে থাকা উচিত। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে, একটি কোয়ারেন্টিন স্পেস অবশ্যই অনেক খোলামেলা হওয়া চাই। না হলে চারদেয়ালের মাঝে থাকতে থাকতে রোগীর ক্লান্তিবোধ আরো বেড়েই চলবে।
তাই আসবাবপত্র দিয়ে ঠাসা রুম এখানে কাম্য নয়। কোয়ারেন্টিন স্পেসে অপ্রয়োজনীয় ফার্নিচার তো দরকারই নেই, বরং দরকারি ফার্নিচারের ক্ষেত্রেও স্মার্টফিট ফার্নিচার খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এ রকম স্মার্টফিট ফার্নিচার রিকভারি রুম সহজেই পরিপাটি রাখতেও সহায়তা করে।
একটি কোয়ারেন্টিন স্পেসে অবশ্যই একটি বিছানা এবং বেডসাইড টেবিল প্রয়োজন। বিছানাতেই যেহেতু কোয়ারেন্টিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হয়, তাই বিছানাটি বেছে নেওয়ার সময় অবশ্যই রোগীর আরাম এবং পছন্দকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
বিছানার পাশাপাশি বিছানার ম্যাট্রেসটাও সাবধানে বেছে নেওয়া প্রয়োজন। রোগী কতটুকু আরামে থাকতে পারবে, সেটা অনেকটাই ম্যাট্রেসের ওপর নির্ভর করে। তবে খুবই নরম কিংবা খুবই শক্ত ম্যাট্রেস౼কোনোটিই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
বেডসাইড টেবিলটা ঠিক ততটুকুই বড় হওয়া চাই, যতটুকুতে রোগীর প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পানির গ্লাস-জগ রাখা যাবে। বিছানার আকার ও আকৃতির সাথে বেডসাইড টেবিলটি মানিয়ে গেলে আরো ভালো হয়।
যদি রুম বেশি বড় হয়, তবে এখানে সিটার-কাম-বেডেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাতে রোগী যখন দরকার, তখন সেটাকে বিছানা বানিয়ে নিতে পারবেন। বাকি সময় সোফা হিসেবে ব্যবহার করে রুমে খোলা জায়গা বৃদ্ধি করতে পারবেন।
রুমে একটা ওয়ার্ডরোবও দরকার, যাতে রোগী প্রয়োজনীয় জামাকাপড়, দরকারি মেডিকেলসামগ্রী এমনকি হালকা খাবারদাবারও রাখতে পারেন। বিছানার পাশাপাশি অবশ্যই কমপক্ষে একটা চেয়ার থাকা দরকার, যাতে বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো না লাগলে রোগী বসে সময় কাটাতে পারেন।
সেই চেয়ারটি যেকোনো সাধারণ চেয়ার হতে পারে, তবে রকিং চেয়ার কিংবা ইজিচেয়ার হলেও মন্দ হবে না। তাতে রোগী বসে থাকার সময়ও আরামে থাকতে পারবেন।
যদি জায়গা থাকে, তাহলে কোয়ারেন্টিন স্পেসে একটি ছোট পড়ার টেবিল রাখতে পারেন। রোগী সুস্থ বোধ করলে সেখানে চাইলে পড়ালেখা কিংবা কাজ করতে পারবেন। এর পাশাপাশি খাবার এবং অন্যান্য দরকারি বস্তু আদান-প্রদানের জন্য একটি টি-ট্রলিও কোয়ারেন্টিন স্পেসে থাকা উচিত। তবে এত কিছু না করে চাইলে শুধু বিছানা, বেডসাইড টেবিল, চেয়ার, ওয়ার্ডরোব দিয়েই কোয়ারেন্টিন স্পেস সাজানো যেতে পারে।
কী করবেন এবং কী করবেন না
রিকভারি রুমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অবশ্যই রাখা প্রয়োজন। বেডসাইড টেবিলে একটি অ্যালার্ম ঘড়ি রাখা দরকার, যাতে ঘুমানোর রুটিন ঠিক রাখা যায়।
অ্যালার্ম ঘড়ি ওষুধ খাওয়ার সময় ঠিক রাখতেও সাহায্য করবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিষ্কার থাকার জন্য যা যা দরকার : টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, ঘরে পরার স্যান্ডেল౼সবকিছুই রোগীর হাতের কাছে থাকা উচিত।
রোগী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য ঘরে মাস্ক রাখা উচিত এবং মশার জ্বালাতন থেকে বাঁচতে মশারি। ঘরে অধিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস রাখা উচিত নয়।
তবে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় যাতে তিনি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। এই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো রোগীর হাতের কাছে থাকলে তাকে আর কোনো ধরনের অসুবিধায় পড়তে হবে না।
এগুলোর পাশাপাশি রোগীর দ্রুত সুস্থতা নিশ্চিত করতে পরিবারের অন্য সবাইকে সচেতন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেবল তখনই একটি কোয়ারেন্টিন স্পেস বানানোর উদ্দেশ্য সফল হবে। কোয়ারেন্টিন স্পেস নিয়ে আপনি কী ভাবছেন, তা এখনই আমাদের কমেন্টে জানিয়ে দিন।
লিখেছেনঃ রাহিন আমিন