changing the look of the office changing the look of the office

অতিমারি বদলে দিচ্ছে অফিসের চেহারা

চিন্তা করুন তো, অফিসে ঢুকতে গিয়ে দেখতে পেলেন অফিসের সদর দরজা শপিং মলগুলোর মতো একা একাই খুলে যাচ্ছে। লিফটে উঠছেন, কিন্তু বাটন চেপে উঠতে হচ্ছে না। বরং, মুখে জানিয়ে দিচ্ছেন কত তলায় যাবেন, লিফট মৌখিক নির্দেশেই কাজ করছে। আগে যেখানে অফিসে খোলা জায়গায় অনেক মানুষ একসাথে কাজ করত, এখন সেখানে বড় বড় ডিভাইডার। ডেস্কগুলোও একে অন্যের থেকে অনেক দূরে। কনফারেন্স রুমগুলোয় আগের তুলনায় অর্ধেক চেয়ার, যেগুলোকে একে অন্যের থেকে কমপক্ষে ছয় ফিট দূরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি রুমেই আছে নতুন প্রযুক্তির ভেন্টিলেশন সিস্টেম এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা। 

আপনার কল্পনা করতে কষ্ট হলেও আকিব কিন্তু ঠিকই কল্পনা করতে পারছে। সে কদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসেছে। পড়ালেখার পাশাপাশি সিলিকন ভ্যালির একটি বড় কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপ করার সূত্রে সে জানে, এই ধরনের অফিসের ধারণা বিশ্বজুড়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ, বিশ্ব এখন অতিমারির থাবায় বন্দী। 

প্রায় দুই বছর পার হতে চলল, অথচ কোভিড-১৯ থেকে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি কোনো দেশই। বিশেষজ্ঞরা এখন প্রায় নিশ্চিত, কোভিডের হাত থেকে শীঘ্রই ছাড়া পাচ্ছি না আমরা। কোভিড শুধু তখনই কমে আসার সম্ভাবনা আছে যখন সবগুলো দেশের বেশির ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে। যা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ফলে এই ‘নতুন স্বাভাবিক’-এর মধ্যে দিয়েই আমাদের কাটাতে হবে আরো বেশ কিছুদিন। আমাদের জীবনযাত্রাকেই মানিয়ে নিতে হবে এই বাস্তবতার সাথে। 

দেশে ফিরে আকিব বেশ ভালো একটি চাকরি পাওয়ার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, বাংলাদেশের অফিসগুলোর কর্তৃপক্ষের মাঝে কোভিডের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনার প্রবণতাটা এখনো ঠিকমতো শুরু হয়নি। আর সে কারণে প্রায়ই অফিসের সবাইকে একসাথে বিপদে পড়তে হয়। যেমন দেখা যায়, কোনো কারণে অফিসের যেকোনো একজন কোভিডে আক্রান্ত হলে তার সংস্পর্শে এসেছেন, এমন সবাইকেই করতে হয় অনিশ্চিত জীবনযাপন। আবার বেশির ভাগ অফিসে যেহেতু সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হয় না, তাই এ রকম পরিস্থিতিতে অফিসের বেশির ভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তাই বিপদে পড়েন। কাজেরও ক্ষতি হয়। 

তবে কাজের ক্ষতি থেকেও বড় হয়ে দাঁড়ায় নিজস্ব ক্ষতির ঝুঁকি। করোনা সংক্রমণ থামানো না গেলে অফিসে কর্মরতদের জীবন যেমন ঝুঁকিতে থাকে, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই মহাবিপদে পড়ে তাদের পরিবারের মানুষজন। প্রায়ই দেখা যায়, অফিস থেকে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পরে তরুণ কর্মচারীদের তেমন বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকলেও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে গেছেন তাদের পরিবারের বৃদ্ধ মানুষেরা।   

একদিন অফিস শেষে গল্প করার সময় তাই আকিব তার বসকে কোভিড-যুগের অফিসের ধারণার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কীভাবে কোভিড পাল্টে দিচ্ছে কর্মজীবনে অফিসের ভূমিকা এবং অফিসের সামগ্রিক চেহারা, জম্পেশ আড্ডা চলল সেটা নিয়েই। বহু আলোচনার পর আকিবের বস সিদ্ধান্ত নিলেন, কোম্পানির সামর্থ্য অনুযায়ী কোভিডের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নানা ধরনের কৌশলকে বাস্তবায়ন করার একটা চেষ্টা করে দেখবেন। 

সেদিন আকিব আসলে কীভাবে বুঝিয়েছিল তার বসকে? চলুন জেনে নিই অতিমারি কীভাবে বদলে দিচ্ছে অফিসের চেহারা।

বদলে যাচ্ছে অফিসের ভূমিকা

অফিসের সব কাজ অফিসেই হবে, এই ধারণা প্রাচীন হওয়ার পথে। করোনার কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কিংবা অন্য নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষরাই ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে মূলত দুটি লাভ হয়েছে। একদিকে যেমন করোনার কারণে কাজ থেমে থাকেনি, তেমনি প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পেরেছে, অফিসের সব কাজ আসলে অফিসে করার একদমই প্রয়োজন নেই। বরং যেই কাজগুলো অন্য কারো সাহায্য ছাড়া একা একাই করা যায়, সেই কাজগুলো বাসায় বসেই ভালোমতো করা সম্ভব। আবার দলীয় কাজ বাসায় বসে করার জন্য এখন নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয়, যা ক্রমাগত মানুষের জীবনকে সহজতর করে তুলছে। 

তাই বিশ্বজুড়ে অফিসের ভূমিকা পরিবর্তনেরই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম এবং অফিসে বসে কাজ করা মিলিয়ে একটা ‘হাইব্রিড সিস্টেম’ বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। পারসোনাল কাজগুলো বাসায় বসেই হবে। শুধু টিম এবং ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের মতো যেসব কাজ অফিসের অন্যদের ছাড়া সম্ভবই নয়, মূলত সেই সব কাজের জন্যই অফিসকে ব্যবহার করা হবে। 

এই নতুন হাইব্রিড কর্মজীবনের ধারণা অফিসের সজ্জাতেও বড় ভূমিকা রাখবে। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের নিজস্ব কাজের জায়গাগুলো কমে আসবে, সেই স্পেসগুলো ব্যবহার করা হবে কমন স্পেস কিংবা কনফারেন্স রুমের জায়গা বাড়াতে। কনফারেন্স রুমের বাইরেও পারসোনাল স্পেসের জায়গা কমিয়ে ছোট ছোট মিটিং টেবিল রাখা হতে পারে, তাতে একসাথে কাজ করার জায়গা বাড়বে।  

অফিসের আরেকটি বড় ভূমিকা হবে কর্মচারীদের মাঝে যথেষ্ট সামাজীকরণ নিশ্চিত করে দলের প্রাণশক্তি বাড়ানো। যেহেতু অফিসে মানুষের মাঝে ঠিকঠাক যোগাযোগ নিশ্চিত করতে প্রচুর সামাজিকীকরণ দরকার, তাই অফিসে ক্যানটিন, বারান্দা কিংবা ব্যালকনির মতো সোশ্যাল স্পেসগুলো বাড়ানোর ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখানে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যতক্ষণই অফিসে থাকবে, ততক্ষণই যেন কলিগদের সাথে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দারুণ সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। এতে কর্মচারীরা অফিসে কম সময় কাটালেও দলের প্রাণশক্তি থাকবে অটুট। 

কোভিড-যুগের অফিসের ধারণায় মূলত যত কম মানুষ নিয়ে অফিস করা যায়, সেই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অফিসে মানুষের ভিড় কমাতে আগের মতো একটি হেডকোয়ার্টার না রেখে বরং ছোট ছোট শাখা অফিস খোলার কথাও ভাবছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এতে এক অফিসেই যেমন সব মানুষ থাকতে বাধ্য হবে না, আবার সারা শহরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শাখা থাকবে বলে প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদেরও অফিসে আসতে খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে না। নানা শিফটে ভাগ করে অফিসে মানুষের ভিড় কমানোর চেষ্টাও করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। 

গুরুত্ব থাকবে স্বাস্থ্য এবং সামাজিক দূরত্বের ওপর

প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনেই অফিসে সামাজিক দূরত্বের ওপর প্রাধান্য দেওয়া দরকার। বারবার অফিসে করোনার হানা দিলে দিন শেষে প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কমকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে তাই সারা পৃথিবীতেই নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা হচ্ছে। 

ফার্নিচারের স্মার্ট ব্যবহারের মাধ্যমেই অবশ্য সামাজিক দূরত্ব অনেকটাই নিশ্চিত করা যায়। যেমন, করোনার আগে বিশ্বজুড়ে ‘ওপেন অফিস’ নামে একটি ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এই অফিস সিস্টেমে মূলত কর্মচারীদের একে অন্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। তাই অফিস ডিজাইনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল পারসোনাল স্পেসে ছোট ছোট ডেস্ক এবং যতটা সম্ভব ওপেন স্পেস রাখার প্রচলন। সেই উঠতি জনপ্রিয়তা কোভিডের কারণে এখন অনেকটাই কমে গেছে। 

এখন কর্মচারীরা কাজের সময় যাতে একে অন্যের থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকেন, সে উদ্দেশ্যে অফিসে প্রাচীন আমলের মতো বড় বড় ডেস্ক এবং উঁচু উঁচু ডিভাইডারের ব্যবহার ফেরত আসছে। কো-ওয়ার্কিং স্পেসগুলোও বদলে যাচ্ছে। আগে একেকটি কনফারেন্স রুমে দশজন বসার জায়গা থাকলে এখন সেখানে পাঁচজন বসার জায়গা রাখা হচ্ছে। যথেষ্ট প্রশস্ত কনফারেন্স টেবিল ব্যবহারেরও একটা চল শুরু হয়েছে, যাতে অনেক মানুষ একসাথে থাকলেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যায়।  

changing the look of the office

উঁচু ডিভাইডার দিয়ে আলাদা করা হবে পারসোনাল স্পেস 

অনেক কর্তৃপক্ষই আবার অফিসের কমন হাঁটাচলার স্পেসগুলোকে ওয়ান ওয়ে বা একমুখী করে দেওয়ার কথা ভাবছে। এতে সুবিধা হলো, অফিসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার সময় একে অন্যের মুখোমুখি হতে হবে না। বরং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই হাঁটাচলা করা সম্ভব হবে। 

স্বাস্থ্যের দিকে আলাদা নজর দিতে প্রচুর স্যানিটেশন পদ্ধতি অবলম্বন করার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিটি কমন স্পেস যেন অতিনিয়মিত পরিষ্কার করা হয়, প্রতিটি রুমে যেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্যানিটেশনসামগ্রী থাকে, সেটা নিশ্চিত করা হচ্ছে প্রায় সব জায়গায়-ই। অনেক প্রতিষ্ঠানই ডেস্ক এবং চেয়ারগুলোতে অস্থায়ী কাগজ কিংবা পলিথিন ব্যবহার করার কথা ভাবছে, যেগুলো প্রতিদিন অফিস শেষেই ফেলে দেওয়া হবে। তবে পরিবেশের জন্য ভালো নয় বলে এই ব্যবস্থাটিতে নিরুৎসাহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

changing the look of the office

প্রশ্বস্ত কনফারেন্স টেবিলের ব্যবহার বাড়বে 

বাড়বে প্রযুক্তির ব্যবহার

করোনায় স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির গুরুত্বের অন্ত নেই। এখন অফিসগুলো নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো দিয়ে সহজেই কর্মচারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব। যেমন, লিফটের বাটন, কফি মেশিন, কিংবা দরজার হ্যান্ডেলের মতো অফিসে যেই সারফেসগুলো অনেক মানুষ একই সাথে স্পর্শ করে, সেগুলোর কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই করা সম্ভব। লিফটে ভয়েস কমান্ডের ব্যবস্থা করে, দরজায় এবং কফি মেশিনে সেন্সর লাগিয়ে এই সংক্রমণ কমিয়ে আনা যায়। 

এ ছাড়া ইনডোর স্পেসে যাতে বাতাসের মাধ্যমে করোনা যাতে ছড়াতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে আরো কার্যকরী ভেন্টিলেশন প্রযুক্তি। এয়ার পিউরিফায়ারও ব্যবহার করা হয় অনেক প্রতিষ্ঠানেই। স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন ইউভি আলোর মতো শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্যানিটেশন নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। অসুস্থ কর্মচারীদের ট্র্যাক করার জন্য থার্মাল ক্যামেরা ব্যবহারের প্রচলন বাড়ছে। তবে কর্মচারীদের প্রাইভেসিতে বিপত্তি ঘটাতে পারে বলে অনেক প্রতিষ্ঠানই এর পক্ষে নয়। 

হাসপাতালের আদলে অফিস!

না, না, ভয় পাবেন না। অফিসকেই হাসপাতাল বানানোর চেষ্টা কেউ করছে না। তবে, হাসপাতাল সজ্জায় স্বাস্থ্যসুরক্ষাকেন্দ্রিক যেই ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হয়, সেই একই পদ্ধতিগুলো অফিসেও বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে অনেকেই। যেমন, অফিসে এখন এমন সব ম্যাটেরিয়ালের ফার্নিচার ব্যবহার করার চল এসেছে, যেগুলো নিয়মিত এবং কঠিনভাবে পরিষ্কার করলেও নষ্ট হবে না। ফ্লোর ম্যাট কিংবা পর্দার মতো অন্যান্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে এমন সব ফেব্রিক বেছে নেওয়া, যেগুলো অনেকবার ধোয়ার পরও নষ্ট হবে না। এ ছাড়া হাসপাতালে যেভাবে রোগ ছড়ানো সংবরণ করা হয়, ঠিক একই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে অফিসকেও করোনামুক্ত রাখার চেষ্টা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। 

বোঝা গেল, অতিমারির কারণে অফিসের চেহারা যে পাকাপাকিভাবে পাল্টে যাবে, সেটা আকিব তার বসকে ঠিকই বুঝিয়ে ফেলতে পেরেছিল। আমাদের এই ব্লগ পড়ার পরে আপনি আপনার বসকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তো? এখনই জানিয়ে দিন আমাদের কমেন্টে।

লেখক: রাহিন আমিন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।