ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে, অন্য সব বিষয়ের মত হোম ডেকোর বা গৃহসজ্জাও বিকশিত হচ্ছে। গৃহসজ্জায় আগ্রহী ব্যাক্তিরা নিজেদের সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তোলার জন্য এসব প্ল্যাটফর্মকে ক্যানভাসের মত করে ব্যবহার করছেন। একটা সময় ছিল, যখন হোম ডেকোর কন্টেন্ট বাংলাদেশের বাইরেই বেশি প্রচলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের গৃহসজ্জাপ্রেমীরাও আগ্রহী হয়েছে এক্ষেত্রে অবদান রাখতে। হোম ডেকোর কন্টেন্টের মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের ঘরকে কীভাবে সাজিয়েছে, সেটা শেয়ার করছে। এর সাথে কীভাবে কম খরচে নিজেই ঘর সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা যায়, কীসের সাথে কী মিলিয়ে ঘর সাজালে তা ভালো রুচির পরিচয় দিবে, ইত্যাদি এসব বিষয় নিয়েও কথা বলছে। গৃহসজ্জাপ্রেমীদের মত গৃহসজ্জার উপকরণের কারুশিল্পীরাও বর্তমান যুগে হোম ডেকোর কন্টেন্টকে করে তুলেছে আরো জনপ্রিয়। তারা নিয়ে এসেছে আধুনিক এবং ইউনিক ডিজাইনের সব আসবাবপত্র এবং আনুষাঙ্গিক উপকরণ, যা দিয়ে খুব সহজেই সুন্দরভাবে ঘরকে সাজিয়ে ফেলা যায়।
আজকে আমরা জানব এমন একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের কথা, যিনি তার হোম ডেকোর কন্টেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় দুই লাখ মানুষকে নিয়মিত পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন গৃহসজ্জার বিভিন্ন দিক নিয়ে। আমরা কথা বলব, ডেকোর আপা অন আ বাজেট এবং এর পেছনে থাকা নাজিয়া নাফকে নিয়ে। কিন্তু তার আগে দেখে আসি, ঠিক কী কারণে হোম ডেকোর কন্টেন্ট এত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
হোম ডেকোর কন্টেন্ট দিন দিন এত জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে, নিজ ঘরকে আকর্ষনীয় করে তোলার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বেড়ে যাওয়া। সে সময় আর নেই যখন বাসা-বাড়ি আমাদের জন্য শুধু বসবাসের জায়গা ছিল, আসবাবপত্র ছিল প্রয়োজনীয়তা। এখন মানুষ নিজের ঘরবাড়িকে সাজানোর মাধ্যমেই তার অভিরুচিকে সবার সামনে প্রকাশ করে। এসব হোম ডেকোর কন্টেন্ট দেখে মানুষ ঘর সাজানোর নতুন নতুন আইডিয়া পায় এবং তার ঘরের সাথে কোন আসবাবপত্র মানানসই তা বুঝতে পারে। শুধু নিজের বাড়িই নয়, বরং নিজের অভিব্যক্তির সাথে ঘর সাজানোর কোন স্টাইলটা খাপ খায়, তাও এসব কন্টেন্ট দেখে বোঝা যায়। ছোট একটা ঘরকে কীভাবে সাজানো যায়, কম খরচেই কীভাবে বাড়িকে সেরা চেহারাটা দেয়া যায়, এর সবটাই জানা যায় এই কন্টেন্টগুলো দেখে। এতে করে, ঘর সাজানোর সময় এবং খাটনি দুটোই বেঁচে যায়।
বলছিলাম, নাজিয়া নাফের কথা। গৃহসজ্জা নিয়ে শুরু থেকেই বেশ আগ্রহী ছিলেন নাজিয়া নাফ। অল্প বয়স থেকেই, তিনি তাঁর ঘরটিকে সবচেয়ে সহজ এবং সবচেয়ে কম খরচে সুন্দর করে চলেছেন। ২০২১ সালের দিকে, তিনি নিজে থেকেই ঘুরে ঘুরে এসব গৃহসজ্জা বা হোম ডেকোর কন্টেন্ট দেখা শুরু করেন। তখন পাশের দেশ ভারতের কন্টেন্ট দেখা হত, আবার এর পাশাপাশি নর্ডিক বা বোহো স্টাইলের ডেকোর নিয়ে জানার জন্য অন্যান্য দেশের কন্টেন্টও দেখা হত। এসব কন্টেন্ট থেকে নাজিয়া নাফ খুব ভালো ভালো হোম ডেকোরের আইডিয়া পেলেও, তা খুব একটা কাজে লাগছিল না কারণ, এই জিনিসগুলো বাংলাদেশে কোথায় পাওয়া যায়, খরচ কেমন লাগতে পারে এই নিয়ে তথ্য দেয়ার মত কেউ ছিল না। ডেকোরেশনগুলো চাইলেই তিনি রেপ্লিকেট করতে পারছিলেন কিন্তু তা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। ঠিক তখনই নাজিয়া নাফ খেয়াল করে দেখলেন যে, বাংলাদেশে এরকম হোম ডেকোর কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বলতে গেলে নেই। বাংলাদেশে প্রচুর কন্টেন্ট ক্রিয়েটর রয়েছে, তাদের মাঝে অনেকে বিভিন্ন কন্টেন্টের পাশাপাশি হয়ত নিজের ঘর কীভাবে সাজিয়েছে তা ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। একটা দুইটা কন্টেন্ট বানাচ্ছে হোম ডেকোরেশন নিয়ে। কিন্তু একান্তই হোম ডেকোর নিয়ে কেউ কাজ করছে না। কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের এই একটা ক্ষেত্র বাংলাদেশে পুরো অধরা রয়ে গেছে।
ঠিক একই সময় নাজিয়া নাফকে তার স্বামীর চাকরির সুবাদে একটি দুই রুমের বাসা নিয়ে থাকতে হয় ঈশ্বরদীতে। আবার করোনা মহামারীর জন্য নাজিয়া নাফের নিজেরও চলছিল ওয়ার্ক ফ্রম হোম। খুব অনিশ্চিত একটা সময় হওয়ায় তখন তিনি জানতেন না যে, এখানে কতদিন থাকা লাগবে, তার ওয়ার্ক ফ্রম হোমই বা কতদিন থাকবে, তাই দামী কোনো আসবাব কেনাটা তখন ছিল নিদারুণ অপচয়। কিন্তু যতদিনই থাকেন না কেন, দুই রুমের একটা বাসা তো পুরো খালি রেখে সেখানে থাকাটা অসম্ভব। তাই স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে কাঠ কিনে তারা নিজেরাই বানিয়ে নিলেন একটা প্যালেট সোফা, যেখানে কেউ বেড়াতে আসলে থাকতেও পারবে। বানালেন একটা ডাইনিং টেবিলও। বাড়িতে কাঠ দিয়ে একটা খাটও হয়ে গেল। নাজিয়া নাফ মাত্র সাড়ে পাঁচশো টাকা নিয়ে একটা টেবিল কিনে, সেটাকে রঙ করে একটা শখের টি টেবিলও বানিয়ে ফেললেন। এমনকি একটা ফিশনেট দিয়ে বানিয়ে ফেললেন একটা চমৎকার ঝাড়বাতিও। যেহেতু সেই সময়টা সবার হাতেই টুকটাক সময় ছিল, তাই দেখা যেত নাজিয়া নাফ প্রতিদিনই টুকটাক কিছু না কিছু বানাচ্ছেন। তখনই তাঁর মাথায় আসলো যে, নিজে নিজেই একটা লাইট, সোফা, টেবিল, বা ঘরকে সুন্দর করে সাজানোর জিনিস তৈরি করাটা এদেশের জন্য বেশ নতুন একটা কনসেপ্ট। তাঁর আশেপাশেও কেউই এমনটি করছিলো না। তাই এটি যদি বিপুল পরিমাণের দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, তাহলে সবার তা দেখতেও ভালো লাগবে, আবার অনেক মানুষ এর থেকে উপকৃতও হবে।
কোভিডের সময়টা সবার জন্যই খুব বিষন্ন একটা সময় ছিল, নাজিয়া নাফের জন্যও তা ব্যাতিক্রম ছিল না। তাই কিছু না ভেবে হুট করেই তিনি তাঁর জন্মদিনের দিন হোম ডেকোরের একটা ফেসবুক পেজ খুলে বসলেন এবং সেখানে খুব কম সরঞ্জামাদি দিয়ে, কাঁচা হাতে করা কিছু ভিডিও আপলোড করে দিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে, মানুষ এসব ভিডিওই খুব পছন্দ করছে, কারণ এই কনসেপ্টটি পুরোপুরি নতুন। তিনি বুঝলেন যে, তাঁর মত অনেকেই হোম ডেকোর কন্টেন্টের অভাববোধ করছিলেন। পেজটি রাতারাতি খুব জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল।
এখান থেকেই জন্ম ডেকোর আপা অন আ বাজেট-এর। নাজিয়া নাফ বর্তমানে একটি এনজিওতে গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, এনজিও কালচারের ‘আপা’ ডাক থেকেই ডেকোর আপার উৎপত্তি। শুরুতে পেজটা ছিল স্বল্প খরচে বাড়ি সাজানোর উপায় নিয়ে কিন্তু মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এখন তাতে সব ধরনের হোম ডেকোর কন্টেন্টই আপলোড করা হচ্ছে। তাই নামের সাথে ‘বাজেট’ শব্দটা থাকলেও এখন সব কিছুই পাওয়া যাবে ডেকোর আপা অন আ বাজেট-এ।
বিশ্বব্যাপী যারা ঘর সাজানো নিয়ে খুব শৌখিন, হোম ডেকোরেশন কন্টেন্ট তাদের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এমনকি এর ফলে, যাদের ঘর সাজানো নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই, তারাও নিজ ঘরকে অল্পের মাঝেই সুন্দর করে তুলতে পারছে। যারা নিজ বাড়ি সাজানোর জন্য অনুপ্রেরণা খুঁজছেন, তাদের জন্য এই ভ্লগগুলো খুবই কার্যকরী কারণ এতে থাকে প্রচুর আইডিয়া, টিপস এবং ব্যবহারিক পরামর্শ। হোম ডেকোর কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা প্রায়শই সাশ্রয়ী মূল্যের মাঝে, সহজেই পাওয়া যায় এমন উপকরণ বা আসবাব দিয়ে ঘর সাজানো দেখায়। এ কারণে তাদের সাহায্যে যে কেউ তার স্বপ্নের বাড়িটিকে সুন্দর করে সাজাতে পারে।
ডেকোর আপা অন আ বাজেট-ও তার ব্যতিক্রম নয়। নাজিয়া নাফের ভাষ্যমতে, হোম ডেকোর কন্টেন্টের টার্গেটেড অডিয়েন্স আসলে সবাই, কারণ সবারই নিজের বাসা রয়েছে এবং সবাইই চায় একটু করে হলেও নিজের বাসাটাকে সুন্দর করে সাজাতে। তাই মানুষ যেন ঠিক কোন জায়গাটা থেকে কীভাবে শুরু করবে, তাঁর একটা নির্দেশনা পায়, একারণেই ডেকোর আপা অন আ বাজেট-এর মাধ্যমে নাজিয়া নাফের যাত্রা শুরু হয়ে, এবং দুই লাখ ফলোয়ার নিয়ে এই যাত্রা এখনো অব্যহত রয়েছে।