ঘটনা ১: কাজের সূত্রে সাকিফকে ঢাকার বাইরে বাসা নিতে হয়েছে। সারা জীবন বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থেকেছে সে। কখনো কিছু নিয়েই চিন্তা করতে হয়নি। এখন একা একা থাকতে গিয়ে একরকম অকূল পাথারেই পড়েছে বলা যায়।
যে বাসায় সাকিফ উঠেছে সেই বাসাটা আগে থেকে ফুল ফার্নিশড (full-furnished) অর্থাৎ আসবাবপত্র সব আগে থেকেই ছিল, নতুন করে কিছু নিতে হয়নি। কিন্তু বৃষ্টির মৌসুমে হঠাৎ খেয়াল করল যে বাসায় কাঠের যে সোফা আর আলমারি ছিল, সেগুলো কেমন ফুলে ফুলে যাচ্ছে।
ঘটনা ২: মালিহা আর রাফিদের নতুন সংসার। কেবল গত শীতে বিয়ে হলো। তাদের নতুন বাসার আসবাবপত্রগুলোর অনেকগুলোই কাঠের। হঠাৎ একদিন ওরা লক্ষ করল ওদের কাঠের আসবাবগুলোতে কেমন ড্যাম্প পড়ে গেছে।
ঘটনা ৩: তাসনিম সুলতানা অনেক দিন ধরেই চাচ্ছেন তাঁদের কাঠের আসবাবগুলোকে একটু রং করতে। সামনে আবার তাঁর বড় ছেলের বিয়ে। কিন্তু যতবারই তিনি এ বিষয়ে তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে কথা বলতে চেয়েছেন, ততবারই তিনি কথা দিয়েছেন যে হাতের কাজ শেষ হলেই কাঠের মিস্ত্রির সাথে যোগাযোগ করবেন।
কিন্তু জাহাঙ্গীর সাহেব সময় করে উঠতে উঠতে চলে এল বর্ষাকাল। যদিও তাসনিম চাচ্ছিলেন না এমন সময় আসবাব রং করতে কিন্তু কে শোনে কার কথা। করতে দেওয়া হলো রং এবং এরপর শুকানোর জন্য দেওয়া হলো ছাদে। ফলাফল౼একটু পরপর বৃষ্টির যন্ত্রণায় পুরো কাজটা ভেস্তে গেল।
বর্ষাকালটা ঋতু হিসেবে বেশ সুন্দর। আর পরীক্ষার খাতায় রচনা হিসেবেও লেখার বেশ খোরাক পাওয়া যায়। তবে আসবাবপত্রের কথা চিন্তা করলে এই সময়টা কিন্তু মোটেও সুবিধার না। তবে এই অসুবিধার সময়টুকুর মধ্যেও কীভাবে কাঠের আসবাবপত্রের যত্ন সহজে নেওয়া যায়, তা নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ।
বর্ষাকাল এলেই দেখতাম আমার বাবা একটা কাপড়ে অলিভ অয়েল নিয়ে আমাদের প্রতিটা কাঠের আসবাবপত্র খুব যত্ন নিয়ে মুছত। তা-ও একবার-দুইবার না।
প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার। ছোটবেলা থেকে এই প্রতি বর্ষায় বাবাকে এই কাজ করতে দেখলেই কখনো জিজ্ঞেস করার কথা মাথাতেই আসেনি যে এই কাজ তিনি কেন করেন।
কিন্তু এই ব্লগটি লিখতে বসে যখন বর্ষাকালে কাঠের আসবাবপত্রের যত্ন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হলো, তখন জানতে পারলাম এতে করে বর্ষার সময় কাঠ শুকনো থাকে।
বর্ষায় কাঠের আসবাবের যত্ন নেওয়ার ৫টি উপায়
এই যে আমরা যারা এখন বড় হচ্ছি এবং নিজেদের দায়দায়িত্ব একটু একটু করে নিজেরাই শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছি বা সেই পর্যায়ে রয়েছি কিংবা যারা নতুন সংসার পাতার চিন্তাভাবনা করছি, তাদের কাছে কিন্তু আসবাবপত্রের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারটা খানিকটা নতুন আবির্ভূত এক সংকটের মতো লাগতে পারে।
কিন্তু কিছু সাবধানতার দিকে খেয়াল রাখলে, কিছু উপায় মেনে চললে বর্ষাকালে আমরা কাঠের আসবাবপত্রের যত্ন নিতে পারি খুব সহজেই!
১। আসবাবপত্র থাকুক দেয়াল ও জানালা থেকে একটু দূরে
অনেক সময় পানির পাইপের কারণে দেয়াল ড্যাম্প হয় বা স্যাঁতসেঁতে হয়। আর কাঠের আসবাবপত্র যদি একবারে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়, তবে এর সংস্পর্শে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়তে পারে কাঠের আসবাবেও। তাই কাঠের তৈরি আসবাব একদম দেয়াল ঘেঁষে না রেখে একটু দূরে রাখা উচিত।
আর জানালার কাছে রাখলে আসবাবে বৃষ্টির ছাট লেগে ভিজে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই এমন জায়গায় কাঠের আসবাবপত্র রাখা উচিত যেখানে বৃষ্টির পানি লাগার আশঙ্কা কম। ওপরের প্রথম দুটি ঘটনায় এটাই ঘটেছে। কাঠের আসবাবপত্র রাখা হয়েছিল একদম দেয়াল ঘেঁষে আর জানালার খুব কাছে।
২। পর্যাপ্ত সূর্যের আলোয় যত্নে থাকুক কাঠের আসবাব
বর্ষার মৌসুমে আবহাওয়া এমনিতেই একটু স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সূর্যের আলো কাঠের আসবাবপত্রকে শুকনো রাখতে সাহায্য করে। তাই রোদ উঠলে অন্তত কিছু সময়ের জন্য জানালা খুলে ঘরে রোদের আলো ঢুকতে দেওয়া শ্রেয়।
এখনকার যুগে উঁচু উঁচু দালানকোঠার ভিড় ঠেলে রোদ অনেক সময় ঘরে ঢুকতে পারে না। তা-ও সব সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে না রেখে দিনে কিছু সময়ের জন্য ঘরে আলো-হাওয়া আসার ব্যবস্থা করুন।
৩। কাঠের যত্নে তেল
বর্ষাকালে কাঠের আসবাবপত্র ভালো রাখার একটা ভালো উপায় হচ্ছে জলপাই তেল (অলিভ অয়েল) এবং তিসির তেল দিয়ে আসবাবপত্র নিয়মিত মোছা। এতে করে কাঠের আসবাব শুকনো থাকে এবং স্যাঁতসেঁতে ভাব চলে আসে না।
যেকোনো শুকনো কাপড়ে একটু তেল নিয়ে ভালো করে আসবাবপত্র মুছতে হবে। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন তেল দিয়ে মোছার পর আসবাবপত্র ভালো করে শুকায়।
ভালো করে শুকানোর আগে আবার তেল দিয়ে মোছা অনুচিত। সপ্তাহে অন্তত একবার এবং সর্বোচ্চ দুবার তেল দিয়ে কাঠের আসবাবপত্র মোছা যেতে পারে।
৪। ভেজা কাপড় কখনোই নয়
এই ধুলোর শহরে একটু সময় জানালা খুলে রাখলেই রাজ্যের ধুলাবালি এসে জমা হয় সারা বাড়িতে। তাই আসবাবপত্রগুলো নিয়মিতই কাপড় বা ডাস্টার দিয়ে মুছতে হয়। বর্ষাকালে খেয়াল রাখতে হবে মোছার উপকরণটি যেন শুকনো থাকে।
ভেজা কাপড় দিয়ে মুছলে আসবাবপত্র সেই পানিটুকু শুষে নেয়। ফলে ক্ষতি হয় কাঠের। এর সাথে সাথে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে যদি কাঠের তৈরি আলমারি কিংবা ওয়ার্ডরোব থাকে তবে জামাকাপড় পুরোপুরি না শুকালে তাতে রাখা যাবে না। এতে কাঠের ক্ষতির সাথে সাথে আসবাবপত্রে বিকট গন্ধ ছড়াতে পারে।
৫। এক চিমটি বার্নিশ আর একটুখানি রং রাখে কাঠের আসবাবপত্র টেকসই
সাধারণত বাসাবাড়িতে বছরে একবার আসবাব রং কিংবা বার্নিশ করা হয়। কোনো কোনো বাড়িতে আবার প্রতি দুই কিংবা তিন বছর অন্তর একবার রং কিংবা বার্নিশের কাজ করা হয়।
কিন্তু নিয়মিত কাঠের আসবাবপত্র বার্নিশ কিংবা রং করলে তাতে ড্যাম্প পড়ার আশঙ্কা যেমন কমে যায়, তেমনি আসবাবপত্র থাকে ভালো। আর দেখতেও নতুনের মতো মনে হয়।
তাই তৃতীয় ঘটনার তাসনিম সুলতানা নতুন আত্মীয় বাড়িতে আসার আগেই কাঠের আসবাবগুলো রং করতে চাইছিলেন।
৬। রং বা বার্নিশ করতে হবে বর্ষার আগেই
কাঠের আসবাবপত্র বার্নিশ ও রং করার কাজ একেবারেই সহজ নয়। কারণ কাঠের আসবাব টেনে বের করা, সেগুলোকে বার্নিশ কিংবা রং করা, তা শুকানো এরপর আবার আগের জায়গায় কিংবা নতুন করে ঘর সাজানো౼এসব বড্ড ঝামেলার কাজ।
আর এই কাজ আরও কঠিন হয়ে যায় বর্ষার সময়। কারণ তখন শুকাতে সময় আরও বেশি লাগে। তাই এই কাজগুলো তৃতীয় ঘটনার জাহাঙ্গীর সাহেবের মতো রেখে না দিয়ে বর্ষা আসার আগেভাগেই শেষ করে ফেলা।
৭। কাঠের আসবাবকে দিন ন্যাপথলিন ও নিমের সুরক্ষা
কাঠের আলমারি কিংবা ওয়ার্ডরোবে কাপড়ের গন্ধ হওয়া খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আর তার সাথে যদি যোগ হয় পোকামাকড়ের সমস্যা, তাহলে তো বিশাল ঝামেলা! এই ক্ষেত্রে ন্যাপথলিন হতে পারে একটি ভালো সমাধান। আর এর পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে শুকনো এবং পরিষ্কার নিমের পাতাও।
৮। ব্যবহার করতে পারেন হিউমিডিফায়ার
হিউমিডিফায়ার এমন একটা যন্ত্র, যা ঘরের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। আমাদের দেশের আবহাওয়ার কারণে বর্ষাকালে আমাদের ঘর এমনিতেই বেশ আর্দ্র হয়ে থাকে।
যে কারণে কাঠের আসবাবপত্র স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। হিউমিডিফায়ার যেহেতু ঘরের তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাতে কাঠের আসবাবপত্র শুকনো এবং ভালো থাকে। ঘরে হিউমিডিফায়ার থাকলে ভারী আসবাবের ক্ষেত্রে যত্ন নিতে সুবিধা হয়।
পরিশেষে, এই পদ্ধতিগুলো সাধারণত আমাদের বাসাবাড়িগুলোতে বেশি প্রচলিত। তবে এগুলোর পাশাপাশি যদি আপনি কিংবা আপনাদের পরিবারের কোনো সদস্য ভিন্ন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন, তবে সেটা অবশ্যই আমাদের কমেন্টে জানাবেন।