রাফা বড় হয়েছে একদম আটপৌরে বাঙালি পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই নিজের পরিবারের প্রায় সব সদস্যের মাঝেই নিজ নিজ জায়গা থেকে এই বাংলা সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এবং সম্মান করার একটা বিষয় দেখে বড় হয়েছে ও। পরিবারের সাথে উদযাপন করেছে নানা রকম বাঙালি উৎসব-পার্বণ। তাই যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দেশের বাইরে যেতে হলো, তখন ডরমিটরিতে নিজের ছোট্ট ঘরটাকে সাজানোর জন্য রাফা দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল কিছু টুকটাক জিনিস। আর ডরমিটরিতেই ওর পরিচয় হয় রাজস্থানের উর্মিলা, কাশ্মীরের দানিন, চীনের দাই-উ আর তুরস্কের আয়লিনের সাথে। আর পরিচয়পর্বের সময়ই রাফা লক্ষ করল যে ওর মতো অন্যরাও নিজ নিজ দেশের সংস্কৃতির কিছু অংশ নিয়ে এসেছে ওদের ডরমিটরির ঘর সাজানোর জন্য। দেশের বাইরে এ যেন ছোট্ট এক টুকরো দেশ। আর ওরা যেমন নিজেদের ঘর সাজিয়ে তুলতে ব্যবহার করেছিল নিজ নিজ সাংস্কৃতিকে, তেমনিভাবে পুরো একটা বাসা সাজিয়ে তোলা যেতে পারে যেকোনো সংস্কৃতির আবহকে ধরে রেখে। চলুন তাহলে দেখে আসি কীভাবে কোনো অন্দরমহলে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে বিভিন্ন সংস্কৃতির বাহারি উপকরণ দিয়ে।
বাংলা সংস্কৃতি
বাংলা সংস্কৃতির সবচাইতে জনপ্রিয় উপাদান সম্ভবত নকশিকাঁথা। আগে শুধু গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করলেও এখন নকশিকাঁথা ব্যবহার করা হয় ওয়াল ম্যাট কিংবা বিছানার চাদর হিসেবেও। আর নকশিকাঁথার মোটিফ এখন অহরহ ব্যবহার করা হচ্ছে শাড়ি, টেবিল ম্যাটসহ বিভিন্ন জিনিসে। দেশীয় সংস্কৃতির আরেকটা খুব সুন্দর উপকরণ হচ্ছে হাতপাখা। আগে কাপড়ে সূচিকাজ করা হাতপাখা ব্যবহার করা হতো বাতাস করার জন্য। এই পাখাগুলো দেয়ালে টাঙিয়ে দিলে বেশ অদ্ভুত সুন্দর একটা নান্দনিকতার সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়াও আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা দুইটি শিল্প—মাটির হাঁড়িপাতিল আর টেপাপুতুল এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ঘর সাজানোর কাজে। পটচিত্র বাড়িয়ে তুলছে ঘরের দেয়ালের শোভা। এ ছাড়া রিকশা পেইন্ট এখন ব্যবহৃত হচ্ছে জলচৌকি, বাঁশ, কাচের বোতলসহ নানান তৈজসপত্রে। যা ঘরের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আরও একটা জিনিস যা এখন ঘর সাজানোর জন্য প্রচুর ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হলো বেতের তৈরি ছোট ছোট শোপিস। এই প্রত্যেকটি উপাদান যেমনি সাংস্কৃতিক দিক থেকে অমূল্য, তেমনি প্রাকৃতিক দিক থেকেও বেশ পরিবেশবান্ধব।
বাংলাদেশের বসার ঘরগুলোতে দেশীয় পণ্যের সমাহার চোখে পড়ার মতো
রাজস্থানের সংস্কৃতি
রাজস্থান নামটা শুনলেই আমাদের মাথায় ভেসে ওঠে বাহারি রঙের মেলা। আর আসলেই কিন্তু তাই। আর ঠিক সেই জন্যই রাজস্থানের সংস্কৃতির আদলে ঘর সাজাতে চাইলে থাকতে হবে বাহারি রঙের প্রাচুর্য। রাজস্থানি পোশাকের মাঝে ওদের ছেলেদের মাথার পাগড়ি আর মেয়েদের ওড়নাগুলো খুব যত্ন করে বানানো হয়। আর এই পরনের পোশাক দিয়েও কিন্তু ঘর সাজানোর উপকরণ বানানো যায়। যেমন ঘরের এক কোণে শোপিস হিসেবে সাজিয়ে রাখা যেতে পারে ছেলেদের মাথার পাগড়ি। আর সূচিকাজ করা মেয়েদের ওড়না ব্যবহার করা যেতে পারে ওয়ালম্যাট হিসেবে। এ ছাড়া ওদের শিল্পীরা বিশেষ একধরনের হাতে আঁকা ছবি তৈরি করেন, যাতে ফুটে ওঠে হাতি-ঘোড়াসহ রাজপুতদের জীবনধারার নানান দিক। এই ছবিগুলো হতে পারে অন্দরমহল সাজিয়ে তোলার অনন্য এক উপকরণ।
এর পাশাপাশি রাজস্থানে একধরনের পুতুলখেলা খুব জনপ্রিয়। এবং এই পুতুলগুলো তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। চাইলে এই কাঠের পুতুলগুলো দিয়ে খুব সুন্দর করে ঘর সাজিয়ে তোলা যায়। রাজস্থানি আয়নাগুলো খুব সুন্দর হয়। ঘরের দেয়ালে একটি রাজস্থানি আয়না ঘরের সৌন্দর্য বাড়াবে বৈ কমাবে না।
রাজস্থানের পুরো ব্যাপারটাই যেন রাজকীয়
কাশ্মীরি সংস্কৃতি
কাশ্মীরকে বলা হয় ভূস্বর্গ। আর এই সংস্কৃতির উপাদানগুলো এতটাই চমৎকার যে, এগুলো ব্যবহার করে অন্দরমহলকেই ছোটখাটো একখানা স্বর্গে রূপান্তর করে ফেলা অসম্ভব কিছু না। এই সংস্কৃতির একটা বড় অংশ মুঘল কারিগরদের থেকে এই সংস্কৃতিতে এসেছে। এদের মধ্যে অন্যতম কাগজের মণ্ড থেকে একধরনের তৈরি শিল্প, যা ওয়ালম্যাট, ঝোলানো ল্যাম্পসহ বিভিন্ন রকমের ঘর সাজানোর জিনিস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া কাশ্মীরের বিখ্যাত কাশ্মীরি শাল ব্যবহার করা যেতে পারে শোবার ঘরের বিছানার শোভাবর্ধনে। অর্থাৎ অনেকেই নিজের বিছানায় ঘুমানোর সময় যে গায়ে দেবার চাদর কিংবা কাঁথা ব্যবহার করেন, তা বিছানায় সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। এই কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে কাশ্মীরি শাল।
কাশ্মীরের কার্পেট পৃথিবী বিখ্যাত। এই কার্পেটগুলোতে ঘন কাজ থাকে এবং যেকোনো ঘরের নান্দনিকতা একশ গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে এই কার্পেটগুলো। এ ছাড়া কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে সেখানে অনেক আখরোটগাছের সমারোহ দেখা যায়। এই আখরোটগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় নানান রকম প্রতিকৃতি। যা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি মজবুত ও টেকসই। তাই ঘরের শোপিস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এই আখরোট কাঠের তৈরি প্রতিকৃতি।
কাশ্মীরের এই ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনগুলো পৃথিবী বিখ্যাত
চীনা সংস্কৃতি
চীন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ। এবং ওদের সংস্কৃতির বেশ অনেকগুলো উপাদান ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন চিনামাটি দিয়ে তৈরি কেটলি, চায়ের কাপ, প্লেটসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র দেখতে খুব সুন্দর। এগুলোতে করে মেহমান আসলে যেমন খাবার পরিবেশন করা যেতে পারে, তেমনিভাবে শোপিস হিসেবেও সাজিয়ে রাখা যেতে পারে। চাইনিজ ল্যান্টার্ন বলে একধরনের কাগজের লন্ঠন আছে, যেগুলো ঘরের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিলে ভীষণ সুন্দর দেখাবে। এ ছাড়া চীনা ভাষায় লেখা কোনো ক্যালিগ্রাফি শোভা পেতে পারে ঘরের ওয়ালম্যাট হিসেবে।
চীনে ফোল্ডিং স্ক্রিন বলে একটা জিনিস ব্যবহার করা হয় প্রায় সব বাসাতেই। এবং প্রায় সময়ই এই ফোল্ডিং স্ক্রিনগুলোতে নানা রকম ছবি আঁকা কিংবা খোদাই করা থাকে। এগুলোও কিন্তু ঘর সাজাতে খুব কাজে দেয়। আর চীনা চিত্রকর্মের পুরো পৃথিবীতে জুড়ি মেলা ভার। এই চিত্রকর্মগুলো টাঙিয়ে দেওয়া যেতে পারে ঘরের কোনো এক দেয়ালে। চীনা সংস্কৃতির আরও একটি খুব বিখ্যাত উপকরণ হলো ওদের হাতপাখা, যা তৈরি হয় বাঁশ, কাঠ, সিল্ক ইত্যাদি দিয়ে। এই জিনিসটিকে বলা যায় চীনা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। বিভিন্ন রঙের এবং আকারের চীনা হাতপাখা দিয়েও সাজিয়ে তোলা যায় ঘরের একটি দেয়াল। আর বিভিন্ন বুদ্ধমূর্তি কিংবা অন্য রাজরাজড়াদের ভাস্কর্য ঘরের নান্দনিকতায় এনে দেয় ভিন্ন এক মাত্রা।
চীনা সংস্কৃতির উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে ঘর
তুর্কি সংস্কৃতি
তুরস্ক এমন একটা দেশ, যেখানে যাওয়ার স্বপ্ন প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় দেখেছে। যেমন সুন্দর দেশ, তেমনি সুন্দর তার সংস্কৃতি। তুর্কি সংস্কৃতির একটা বিশেষ উপাদান হচ্ছে ওদের ফ্লোরাল ইজনিক মোটিফের টাইলস। এই টাইলসগুলোতে নীল রঙের আধিপত্য পাওয়া যায়। আর দেখতেও ভীষণ চমৎকার। যেকোনো দেয়াল কিংবা মেঝেতে এনে দেবে ভিন্ন এক চমক। তবে এই টাইলস মেঝেতে ব্যবহার না করে মেঝেতে দেওয়া যেতে পারে ওদের বিখ্যাত ঔশাক কার্পেট-ও। আর ঘরের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিতে পারেন একটি তুর্কি ঝাড়বাতি।
পৃথিবী বিখ্যাত এই কার্পেট আর ঝাড়বাতি যেকোনো জায়গার নকশা বদলে দিতে বাধ্য। তুরস্কে আরও যে জিনিসটির খুব আধিপত্য দেখা যায় তা হলো তামার তৈরি নানান তৈজসপত্র। আর এই তৈজসপত্রগুলো খাওয়ার জন্য যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি ব্যবহার করা যায় শোপিস হিসেবেও। ব্যস! এভাবেই নিজের ঘরের ভেতর তৈরি করে ফেলতে পারেন এক টুকরো তুরস্ক।
তুরস্কের নীল রঙের বিশেষত্ব বোঝা যায় এই ধরনের নীল রঙের টাইলস দেখে
তবে হ্যাঁ, কেউ যেমন নিজ সংস্কৃতির পুরোটাই ফুটিয়ে তুলতে পারে অন্দরমহলের গৃহসজ্জার মাধ্যমে, তেমনি আবার বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়েও সাজিয়ে তোলা যায় ঘর। আপনাদের গৃহসজ্জায় যদি কোনো বিশেষ সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়, তবে কমেন্টে আমাদের জানাতে ভুলবেন না যেন!