চাকরি হোক কিংবা ব্যবসা, প্রাত্যহিক ব্যস্ততার একটা বড় অংশজুড়েই থাকে আমাদের কর্মক্ষেত্র। কাজের জায়গায় সকলেই চায় কীভাবে উন্নতির পথ আরো প্রশস্ত করা যায়, কীভাবে আরও প্রোডাক্টিভ হওয়া যায়। তবে আশানুরূপ প্রোডাক্টিভিটি অর্জনে সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে আপনার কর্মক্ষেত্র যদি তার ভিতরে পরিবেশ আপনার মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা না করে এবং কাজের মান উন্নয়নে সহায়ক না হয়। চলুন জেনে নেয়া যাক কিভাবে একটি প্রোডাক্টিভ পরিবেশ আপনার প্রোফেশনাল জীবনকে আগা-গোড়া পরিবর্তিত করে দিতে পারে এবং যেভাবে আপনি চাইলেই আপনার কর্মক্ষেত্রটিকে করে তুলতে পারেন আরও প্রোডাক্টিভ।
প্রোডাক্টিভ কর্মপরিবেশের উপকারিতা
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য একটি সহায়ক কর্মপরিবেশ তৈরি করার কিছু উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো:
বর্ধিত মনোযোগ
একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ কাজের জায়গা আপনাকে চারপাশের বিরক্তিকর বিষয়গুলো থেকে দূরে থেকে স্পষ্টভাবে আপনার কাজে মনোযোগ দিতে সাহায্য করবে। এটা আপনার সফল হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিবে। ফলশ্রুতিতে, আপনার জীবনের মান এবং আয় দুইক্ষেত্রেই আপনি অভাবনীয় উন্নতি পরিলক্ষিত করতে পারবেন। অন্যদিকে, একটি এলোমেলো কেওটিক কর্মস্থান আপনার স্বাভাবিক উন্নতির অন্তরায়। বারবার বিঘ্নিত হলে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যা আপনার কাজের সময় বাড়িয়ে দেয়।
উন্নত কাজের মান
যখন আপনি একটি নির্দিষ্ট, মনোযোগে সহায়ক জায়গায় কাজ করেন, তখন আপনার কাজের মানও উন্নত হয়ে থাকে। আপনি বাসায় থাকুন বা অফিসে, এমন একটি জায়গা থাকলে যা আপনাকে উৎপাদনশীল হতে উৎসাহিত করে এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে, তখন কাজের সফলতার সম্ভাবনা বাড়ে।
উন্নত গ্রাহক সন্তুষ্টি
নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতা আপনার কাজে এনে দিবে অভূতপূর্ব সন্তুষ্টি। কাজের সন্তুষ্টি প্রতিফলিত হবে আপনার কাজের আঙ্গিক, কৌশল এবং সর্বাঙ্গীণ মানে। আপনার কাজের মানের উৎকৃষ্টতা আপনার প্রফেশনাল জীবনে তারতম্য ঘটাবে। সর্বোপরি আপনার কাজের গ্রাহক এবং সমালোচকবৃন্দের কাছে আপনার কাজের সমাদর বৃদ্ধি পাবে। যা আপনার আয়, সুনাম এবং ব্যক্তিগত জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি
একজন কর্মশীল মানুষের দুশ্চিন্তার প্রথম পয়েন্টটিই থাকে তার কাজে দীর্ঘসময় মনোযোগ দেবার অপারগতা। যা তার উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং সাফল্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। যখন আপনার এমন একটি জায়গা থাকে যেখানে আপনি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারেন, তখন আপনি আপনার আউটপুট বাড়াতে পারেন কারণ সেখানে বিরক্তির সুযোগ কম থাকে। আপনার উৎপাদনশীলতা সন্তুষ্টিজনক হয় এবং আপনার মনের উপর থেকে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার বোঝা কমিয়ে দেয়।
উন্নত নিয়ন্ত্রণ
যখন আপনি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য কর্মক্ষেত্রে থাকেন, তখন আপনি বুঝতে পারেন কী কী বিষয় আপনার উৎপাদনশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং কোন বিষয়গুলো আপনার কাজের অগ্রগতি এবং তার জন্য সৃজনশীল সমাধান খুঁজে পান। নিজের কাজের জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে আপনি জানেন কীভাবে সেটি আপনার কাজের জন্য উপযুক্তভাবে গড়ে তুলেছেন এবং যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
আপনার কর্মক্ষেত্রকে আরো প্রোডাক্টিভ করে তুলবার ৬ উপায়
একটি প্রোডাক্টি কর্মক্ষেত্র আপনার কাজের মান ও গতি বাড়িয়ে দেবে অকল্পনীয়ভাবে। এমন ভাবনায় চলুন আপনাকে ছয়টি পরামর্শ দেওয়া যাক।
১. বসার জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যময়তা
কর্মক্ষেত্রে প্রায় সারাদিনই আমাদের বসে কাজ করতে হয়। বসার জায়গায় স্বাচ্ছদ্যবোধ না করলে প্রোডাক্টিভ তো পরের বিষয়, কাজে মনোযোগই তো আসবে না, তাই না? তাই বসার মাধ্যম হিসেবে চেয়ার কিংবা সোফার প্রতি দিতে হবে আলাদা গুরুত্ব।
যারা চেয়ারে বসেই কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে ফার্ণিচার ব্র্যান্ডগুলোতে অনেক অপশনই দেখা যায়। সুইভেল চেয়ার, ফিক্সড চেয়ারসহ নানা ধরন আর ডিজাইনের এসব চেয়ারের ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় ভিন্নতা রয়েছে। সুইভেল চেয়ার ফ্লেক্সিবল হওয়ায় এই চেয়ারেই অফিসের কাজে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার হার বেশি। তাছাড়া, সুইভেল চেয়ারের অসংখ্য ডিজাইন রয়েছে যার মধ্যে থেকে আপনি আপনার কর্মক্ষেত্রের জন্য সেরা চেয়ারটি বেছে নিতে পারেন। এই চেয়ার ব্যবহারে কর্মক্ষেত্রে যেমন স্বাচ্ছন্দ্য আসবে তেমনি কাজের প্রতি বাড়বে মনোযোগও।
ছবি: সুইভেল চেয়ার
কর্মক্ষেত্রে আরেক প্রচলিত চেয়ার হচ্ছে ফিক্সড চেয়ার। এই চেয়ারগুলো সুইভেল এর মতো ফ্লেক্সিবল না হওয়ায় সটান হয়ে একই ভঙ্গিমায় বসে থাকতে হয়। তবে এই চেয়ারের চাহিদা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ এর সুপিরিয়র কোয়ালিটি। সুইভেল চেয়ার সকল কর্মক্ষেত্রে তেমন দেখা না গেলেও এই ফিক্সড চেয়ার দেখা যায় হার হামেশাই। ভিন্ন ভিন্ন কালার কম্বিনেশন এবং ডিজাইনের কারণেও অনেকেরই পছন্দের শীর্ষে রয়েছে এই চেয়ার।
ছবি: ফিক্সড চেয়ার
চেয়ারে বসে তো আর সারাদিন কাজ করবেন না, করা উচিতও নয়। ওয়ার্কপ্লেসে তাই সোফার বন্দোবস্তও দেখা যায় আজকাল। বাসায় সচরাচর যেসব সোফা দেখা যায় তার সাথে অফিসের সোফার পার্থক্য নেই বললেই চলে। তবে অফিস বা কর্মক্ষেত্রে সাধারণত সাধারণ ডিজাইনের সোফার চলই বেশি দেখা যায়। বলা হয়ে থাকে, প্রোডাক্টিভ কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীদের সাথে হালকা আলোচনার জন্য সোফাই হতে পারে সেরা সমাধান। তাছাড়া কাজের ফাঁকে কিছুটা রিফ্রেশমেন্টের জন্য সোফায় বসে বই পড়া বা গান শুনতে পারেন।
ছবি: অফিস সোফা
হালকা আলোচনা বা ক্যাজুয়াল মিটিংয়ের বাইরে অফিসিয়াল মিটিং একটি কর্মক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রায় প্রতিদিনই নানা ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অফিস মিটিংয়ের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে সকল কর্মকর্তারা কনফারেন্স টেবিলকে মিটিংয়ের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারেন। কনফারেন্স টেবিল একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে কাজের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। একসাথে বসে আলোচনার প্রেক্ষিতে যেকোনো জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কনফারেন্স টেবিল অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে। এতে প্রতিষ্ঠানের সাফল্য যেমন বিকশিত হয় তেমনি একে অপরের মতামত শোনার মাধ্যমে ব্যক্তিগত জ্ঞানও সমৃদ্ধ হয়।
২. ফাইলপত্র অগোছালো নয়
যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই ফাইলপত্র, কাগজ কিংবা নানা ধরনের ডকুমেন্ট এক অপরিহার্য অংশ। এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বা ডকুমেন্ট নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে না রাখার কারণে প্রয়োজনের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে কাজের গতি কমে, আটকে থাকে অনেক কাজও। এক্ষেত্রে তাই নিয়মিত প্রয়োজনীয় কাগজ বা ফাইল নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে রাখায় অভ্যস্ত হতে হবে। ফাইলপত্র নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে রাখতে তিন ধরণের ফার্ণিচার ব্যবহার করা যেতে পারে।
দীর্ঘদিন সংরক্ষণে রাখতে হবে এমন ফাইল রেখে দেওয়ার জন্য আলমারি ব্যবহার করতে পারেন। গতানুতিক আলমারি নয় অবশ্য, কেবিনেট আলমারি। এই আলমারিগুলো বেশ টেকসই হওয়ায় ফাইলপত্র নষ্ট হওয়ারও ঝুঁকি নেই।
ছবি: অফিস আলমারি
ফাইলপত্র খুব বেশি না হলে কিংবা হাতের কাছে যখন তখন দরকার হয় এমন ফাইল নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে রাখার জন্য ফাইল কেবিনেট ব্যবহার করতে পারেন।
ছবি: ফাইল কেবিনেট
এর বাইরে স্টোরেজ রেক পাওয়া যায় বাজারে, যেখানে অফিসের প্রয়োজনীয় মালামাল রাখা যায়।
৩. ওয়ার্ক স্টেশনে গুরুত্ব দিন
কর্মক্ষেত্রে একই ছাঁদের নিচে অনেকে কাজ করার সুবিধার জন্য ওয়ার্ক স্টেশন বেশ কাজের জিনিসই বটে। যেখানে বসে কাজ করছেন, সে জায়গাটাই যদি কর্মীদের মনমতো না হয়, তাদের স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান না করতে পারে, তবে কাজ করার স্পৃহা ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়তে পারে। রুমের দৈর্ঘ্য এবং কর্মী সংখ্যাভেদে কাস্টমাইজ ওয়ার্ক স্টেশন ব্যবহার করে যায়। এক্ষেত্রে কাজের সুবিধা ও গুরুত্ব অনুযায়ী মডিফাই করে নিতে পারবেন ওয়ার্ক স্টেশন।
ছবি: ওয়ার্ক স্টেশন
৪. প্রাকৃতিক আবহাওয়াটাও থাকুক
বদ্ধ চার দেয়ালের মধ্যে কৃত্রিম আলোর ঝলকানিতে সারাদিন কাজ করতে গেলে মনের উপর আলাদা চাপ পড়তে পারে। এজন্য কৃত্রিমের চেয়ে প্রাকৃতিক আলোকেই গুরুত্ব দিয়ে কর্মক্ষেত্রের ইন্টারিওর ডিজাইন করা উচিত। এক্ষেত্রে অফিসের ভেতরে সূর্যের আলো ঢুকার ব্যবস্থা রাখা উচিত। মিষ্টি রোদে কাজের প্রতি আগ্রহও বাড়বে। কাজের ক্ষেত্রে প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে তুলতেও এটি বেশ কার্যকর উপায়।
তাছাড়া, অফিসের বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগাতে পারেন। গাছ লাগাতে ব্যবহার করতে পারেন টব কিংবা পট। গাছ যেমন মনকে প্রফুল্ল করে তুলবে তেমনি কাজের স্পৃহাও বাড়িয়ে তুলবে। তাছাড়া, গাছের প্রাকৃতিক ছোঁয়া অফিসের গুমট ভাব দূর করবে।
৫. একটু ব্রেক চাই
সকালে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা উচিত নয়। কাজের ফাঁকে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিন। সে সময়টা গান শুনুন বা সহকর্মীদের সাথে অফিসের বাইরের বিষয় নিয়ে হালকা আলোচনা করুন। কোনো একটি টার্গেট পূরণ করেও এই ব্রেক আপনি নিতে পারেন। এতে করে কাজের গতিও বাড়বে। তাছাড়া টানা কাজ করে একঘেঁয়েমি ভাব চলে আসা থেকে বাঁচতেও কাজে দেবে এই ব্রেক। তবে ব্রেক টাইম খুব বেশি হওয়া উচিত নয়। তাতে কাজের সময়টাই নষ্ট হবে। ব্রেক কতটুকু নেবেন সে বিষয়টি নিজেই চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করুন।
৬. বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ আছে তো?
আপনি কাজের খাতিরে অফিসের বসের সাথে কথা বলতে গিয়ে যদি কাঁচুমাচু ভাব নিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবে কাজেরই ক্ষতি হবে। বসকে ভয় পেয়ে সিদ্ধান্ত বা মতামত নিয়ে খোলামেলা আলোচনার অভাবে অনেক জরুরি বিষয়েও স্বচ্ছতার জায়গায় প্রশ্ন থেকে যায়। তাই অফিসে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে অবশ্য উর্ধ্বতন কর্মকতাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কর্মীদের খোলামেলা আলোচনার স্পেস দিতে হবে। এতে করে কাজের প্রতি কর্মীদের ডেডিকেশন বাড়বে। এতে করে কাজের গতিও যে বাড়বে তা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
কর্মক্ষেত্রকে নিজের আপন জায়গা ভেবে নিয়ে কাজ করলে যে কোনো কাজেই প্রোডাক্টিভিটি বাড়িয়ে নেওয়া এমন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। চেষ্টার সবটা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি অফিসের পরিবেশটা তাই হওয়া চাই স্বাচ্ছন্দ্যময়।
সারকথা
কর্মক্ষেত্রে সফলতার প্রশ্নে একটি প্রোডাক্টিভ পরিবেশের কোন বিকল্প নেই। একটি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ বসার জায়গা, যেখানে ফাইলপথ এবং ডকুমেন্টস সাজিয়ে রাখার জন্যে পর্যাপ্ত রেক এবং কেবিনেট সুবিধা আছে, এবং যেখানে আপনার সহকর্মীরা আপনার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ, এমন পরিবেশে আপনি খুব দ্রুত উন্নতি করতে পারবেন। এমন কর্মক্ষেত্র যেমন আপনার কাজের প্রতি আপনার মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করবে, তেমনি আপনার কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে দিবে শত গুণে। আপনার প্রফেশনাল ক্ষেত্রে দ্রুতই আপনি পৌছে যেতে পারবেন উন্নতির শিখরে।