ঘটনা ১: সুরভীর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন থেকে শুরু হয়ে গেল লকডাউন। ফলে পড়াশোনা, পরীক্ষা সব চলতে থাকল অনলাইনে।
এমনিতে পড়াশোনার কাজ ভার্সিটির রিডিংরুমে সারলেও লকডাউনের সময় বাসায় বসে পড়াশোনা করাটা বেশ দুরূহ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে লাগল।
আর অনলাইন ক্লাসগুলোর সময় বসার জায়গা নিয়ে প্রতিদিন একটা করে নতুন ঝক্কি পোহাতে সুরভীর একদম ভালো লাগছে না। তাই সে চিন্তা করছে কী করা যায়।
ঘটনা ২: নাবিলার নতুন চাকরি। এই মহামারিতে অফিসে যাওয়ার ঝক্কি নেই, করতে হবে হোম অফিস। কিন্তু একটানা বিছানায় বসে কাজ করতে গিয়ে নাবিলা লক্ষ করল অল্পতেই বেশ পিঠে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আর তাতে কাজে মন দেওয়ার বদলে বাড়ছে অস্বস্তি।
ঘটনা ৩: দানিয়া আর দিয়ানা দুই বোন। দানিয়ার বয়স ১৩ বছর আর দিয়ানার ৯। ওরা প্রতিদিন অ্যাপার্টমেন্টের অন্য বাচ্চাদের সাথে বাসার সামনের মাঠে খেলতে যেত। মহামারির কারণে সারা দিন বাসায় থাকতে হচ্ছে বলে বেশ মনমরা হয়ে থাকে দুজন। ওদের মা বেশ চিন্তিত এই বিষয়টা নিয়ে।
ঘটনা ৪: আনিকার বেশ কিছুদিন ধরেই শরীর জ্বর জ্বর। সাথে কোভিড-১৯-এর অন্যান্য উপসর্গও দেখা দিচ্ছে। তাই টেস্ট করানোর সাথে সাথেই সে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওদের গেস্টরুমে আইসোলেশনে চলে গেল।
মহামারির কারণে আমাদের প্রত্যেকের জীবন নানানভাবে বদলে গেছে । আমাদের বাসায় থাকতে হচ্ছে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ অনেকখানি বেশি। আর তাই আমাদের গৃহসজ্জায় আনতে হচ্ছে সেই অনুযায়ী বেশ কিছু পরিবর্তন। চলুন, একনজরে দেখে আসা যাক মানুষ কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখছে গৃহসজ্জার পরিবর্তনে।
একই ঘরের বহুবিধ ব্যবহার
মহামারির কারণে এখন আমাদের চলাচল শুধু বাসার চারদেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ। তাই বদলেছে ঘরের সংজ্ঞাও। আগে যেই ঘর ব্যবহার করা হতো শুধু খাবার খাওয়ার জন্য, এখন হয়তো বড় টেবিল থাকার কারণে সেই ঘরে বসে অফিসের কাজ কিংবা পড়াশোনা করাটা বেশি সুবিধাজনক।
তাই একটু বড় পরিবার হলে অর্থাৎ পরিবারে একজনের বেশি শিশু থাকলে কিন্তু খাবার টেবিলে সবার একসাথে পড়াশোনা করার ব্যাপারটা যেমন শিশুদের মনে আনন্দ জাগাবে, তেমনি যিনি পড়াশোনার তদারকি করছেন, তার পক্ষেও কাজটা কিছুটা সহজ হবে। অনেক বাসায় ড্রয়িংরুম শুধু বাসায় মেহমান এলে বসতে দেওয়ার একটা ঘর ছিল।
কিন্তু অনেক বাসাতেই এখন সব সদস্য মিলে টেলিভিশন দেখার কিংবা গল্পগুজব করার জন্য বসার ঘর বেছে নিচ্ছেন। আর এ জন্য বদলাচ্ছে বসার ঘরের আসবাবপত্রের সজ্জাও।
আগে যেমন সোফাগুলোর অবস্থান একটু কাছাকাছি রাখা হতো, আর সেন্টার টেবিল রাখা হতো মাঝে, এখন চেষ্টা করা হয় সোফাগুলো এবং সেন্টার টেবিল দেয়াল ঘেঁষে রাখার।
তাতে মাঝে অনেকখানি জায়গা পাওয়া যায়। এবং এই জায়গাটুকু অনেকেই ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম কিংবা পরিবারের সকলে একসাথে বসে আড্ডা দেবার কাজে ব্যবহার করেন।
ঘটনা-৩-এর দানিয়া আর দিয়ানার মা কিন্তু এভাবেই বসার ঘরে তার বাচ্চাদের একটা খেলার জায়গা করে দিতে পারেন। সেখানে তারা নিজেদের মতো খেলাধুলা করার পাশাপাশি গান কিংবা নাচের অনুশীলন করা, ছবি আঁকার মতো কাজ সারতে পারবে।
নিজের একটা আলাদা কাজের জায়গা
খাবার টেবিলে বসে ছোটদের পড়াশোনা করাটা সহজ হলেও একটু বড়দের জন্য কিন্তু আলাদা জায়গা প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে নিজের শোবার ঘরে কিংবা বসার ঘরে কিন্তু কাজের জন্য ছোট্ট একটা জায়গা করে নেওয়া যায়।
এতে কাজে কিংবা পড়াশোনায় যেমন ব্যাঘাত ঘটে না, তেমনিভাবে কাজ করে স্বস্তি পাওয়া যায়। ঘটনা-২-এর নাবিলার মতো পিঠে ব্যথার শিকার কিন্তু আমরা প্রায় সবাই হয়েছি। এবং এর বড় একটা কারণ বিছানায় বসে, ঝুঁকে একটানা কাজ করা।
আবার ঘটনা-১-এর সুরভীর মতো অবস্থায়ও আমাদের অনেকের পড়তে হয়েছে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস কিংবা অনলাইন পরীক্ষার সময় আমাদের প্রয়োজন একটুখানি নিরিবিলি জায়গা।
এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা নিজেদের জন্য একটা ছোট্ট কর্নার বানাতে পারি। আর যেহেতু সচরাচর এই কাজের জায়গাটুকু শোবার ঘরে হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে আমরা ফোল্ডিং টেবিল ব্যবহার করতে পারি।
এই টেবিলগুলো যেমন কম জায়গা নেয়, তেমনি অস্থায়ী কাজের জায়গায় রাখার জন্য একদম মানানসই।
আর যেহেতু অফিসের কাজ কিংবা অনলাইন ক্লাস দুটোতেই দিনের একটা বিরাট অংশ ব্যয় হয়, তার জন্য আলাদা সুইভেল চেয়ার জাতীয় কিছু থাকলে পিঠব্যথা খুব সহজেই এড়ানো যায়।
বারান্দা এবং ছাদের ব্যবহার
গৃহবন্দী এই সময়টায় আমরা সবাই একটুখানি মুক্তি খুঁজি। একটু আকাশ দেখার জন্য অনেক সময় মন কেমন করে ওঠে। একটু বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য কেমন হাঁসফাঁস লাগতে থাকে।
এই সময়টায় একটু বাইরের আলো-বাতাস পাওয়ার খুব ভালো দুটো জায়গা বাসার বারান্দা আর ছাদ।
একটু সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস থাকলে বারান্দায় সকালের চা খেতে খেতে সূর্যোদয় দেখা যায়; কিংবা নরম রোদে ছাদে বসে পুরো পরিবার মিলে একসাথে বিকেলে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করা যায়। আর তাই বারান্দা
কিংবা ছাদে পাতা যায় চেয়ার-টেবিল। ঘটনা-৩-এর দানিয়া-দিয়ানার মা-ও কিন্তু তার মেয়েদের সাথে ছাদে কিংবা বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ খেলাধুলা করতে পারেন।
এতে করে ওদের মন যেমন ভালো থাকবে, তেমনিভাবে মায়ের সাথে একসাথে কিছু সময়ও কাটানো যাবে।
আইসোলেশনের জন্য আলাদা ঘর
মহামারির কারণে আমাদের বাসায় মেহমান আসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই কারো বাসায় যদি মেহমানদের জন্য আলাদা কোনো ঘর থাকে, সেই ঘরকে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা যেতে পারে আইসোলেশনের জন্য।
যেমন ঘটনা-৪-এর আনিকা করেছিল। এ ক্ষেত্রে খাটের পাশে রাখা যেতে পারে ছোট বেডসাইড টেবিল। তাতে করে ওষুধসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যাবে।
তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন ঘরে অনেক আসবাবপত্র যেন না থাকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁটাচলায় সমস্যা হতে পারে।
আর আইসোলেশনের জন্য আলাদা ঘর থাকলে পরিবারের অন্য সদস্যের জন্য দূরত্ব বজায় রাখাটাও কিছুটা সহজ হয়ে যায়। তবে বাসায় যদি বাড়তি ঘর না থাকে তাতেও কোনো সমস্যা নেই।
সে ক্ষেত্রে যেকোনো একটি ঘর আগে থেকে ঠিক করে রাখা যেতে পারে যাতে করে পরিবারের কেউ যদি রোগাক্রান্ত হন, তাকে যেন সহজেই সেই ঘরে স্থানান্তরিত করা যায়।
এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যেন আইসোলেশনের ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসতে পারে এবং ঘর গুমোট না হয়। সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে ঘরের তাপমাত্রা যেন একটু ঠান্ডা থাকে। না হয় রোগাক্রান্ত ব্যক্তির অস্বস্তি হতে পারে।
ঘরে খোলামেলা হাসিখুশি পরিবেশ
মহামারির কারণে এই প্রথম আমরা ঘরবন্দী হয়ে থাকতে শিখলাম। এবং সারাক্ষণ ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে ভর করাটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে আমরা ঘরের আসবাবপত্র এমনভাবে সাজাতে পারি যেন ঘর খানিকটা খোলামেলা লাগে।
এতে করে ঘরে হাঁটাচলা করা সহজ হয়। আর খোলামেলা জায়গায় পরিবারের সবাই মিলে একসাথে সময় কাটাতেও বেশ ভালো লাগে। অনেকেই আবার ঘর পুনঃসজ্জার ক্ষেত্রে বেছে নিচ্ছেন হালকা ধরনের রং।
এতে করে ঘরের পুরো পরিবেশ নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। সেই সাথে ঘরজুড়ে খানিকটা শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে যায়।
আসবাবপত্রে পরিবর্তন
যেহেতু বাসায় বসেই অফিসের কাজ কিংবা অনলাইনে পড়াশোনা সারতে হচ্ছে, তার জন্য অনেকেই পুরোনো আসবাবপত্রের বদলে স্মার্ট ফার্নিচারের ব্যবহার শুরু করেছেন। এর একটা খুব ভালো উদাহরণ হতে পারে সোফা কাম বেড আসবাবগুলো।
এগুলো সবাই মিলে বসে গল্প করা থেকে শুরু করে কাজের মাঝে খানিকটা গড়িয়ে নেওয়া পর্যন্ত সবকিছুর জন্যই যেন মানানসই।
তেমনিভাবে অনেকে ঘরে ঢোকার দরজার সামনেই রাখছেন স্ট্যান্ডজাতীয় আসবাব, যেটা হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য জরুরি জিনিস রাখার কাজে ব্যবহার করছেন।
তবে আসবাবপত্র সজ্জার ক্ষেত্রে শিশুদের ঘরের দিকে একটু আলাদা করে নজর দেওয়া উচিত।
যেহেতু এখন স্কুল-কলেজে যেতে হয় না, বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে বিভিন্ন ভার্চ্যুয়াল গেম কিংবা সিনেমা সিরিজ।
আর ঘরে সারা দিন শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে শরীর ও মন দুটোতেই ভর করে অবসাদ। তাই শিশুদের ঘরের সজ্জা এমন হওয়া উচিত যাতে সেখানে একটু খেলাধুলা কিংবা ছোটাছুটি করার জায়গা থাকে।
শিশুদের ঘরের আসবাবপত্রের আকার-আয়তন বয়স অনুযায়ী ছোট কিংবা বড় হলে ঘরটাও সুন্দর লাগবে।
কোনো শিশু যদি বই পড়তে পছন্দ করে, তবে তাকে বুকশেলফ, বসার জন্য আরামদায়ক সোফা ইত্যাদি দিয়ে বানিয়ে দেওয়া যায় একটি বই পড়ার কর্নার।
অর্থাৎ শিশুর ঘরের সজ্জা হতে হবে তার পছন্দের জিনিসগুলোকে মাথায় রেখে। কারণ, যেই ঘরে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হচ্ছে সেই ঘরের পরিবেশটা সুন্দর থাকলে মন হয়ে ওঠে ফুরফুরে।
মহামারিতে আমাদের জীবনধারায় যেমন পরিবর্তন এসেছে, সেই সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন এসেছে আমাদের গৃহসজ্জাতেও।
আর আপনাদের গৃহসজ্জায় যে পরিবর্তনগুলো এসেছে সেগুলো কিন্তু আমাদের জানিয়ে দিতে পারেন কমেন্টে। অথবা পোস্ট করতে পারেন ছবি-ও।