আজ থেকে প্রায় আনুমানিক ৪০০০ বছর পূর্বে খাটের ব্যবহার শুরু হলেও সোফার ইতিহাস খুব একটা বেশি পুরোনো নয়। অনেকের মতে, চিনের হান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই মানুষ নরম গদি জাতীয় একটা আসবাবের কথা ভাবছিল যেখানে তারা বসে আরাম করতে পারবে। সবার প্রথমে, ঘোড়ার পিঠের উপর বসার জন্য আরামদায়ক কিছু একটা বানানোর কথা ভেবেছিল আর সেখান থেকেই সোফার আইডিয়াটা শুরু। সেই সময় হতে আজ অবধি ধীরে ধীরে সোফার ডিজাইন এবং ব্যবহারে ভার্সেটাইলিটি এসেছে এবং বর্তমানে প্রায় সব পরিবারেই সোফার দেখা পাওয়া যায়। সোফার ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এর নান্দনিকতায় এসেছে বিপুল পরিবর্তন। অনেকের কাছে এটি তাদের রুচির বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম, আবার কারো কাছে এটি আভিজাত্যের প্রতীক। ব্যক্তি ভেদে এই চাহিদার কারণে সোফা তৈরির ম্যাটেরিয়ালেও ভিন্নতা দেখা যায়। স্ট্রাকচার ম্যাটেরিয়াল কাঠের হলেও, সিটিং কভার ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বাংলাদেশে মূলত লেদার এবং ফেব্রিক – এই দুই ধরনের সোফাই নানা ডিজাইনে কিনতে পাওয়া যায়। তবে আপনার জন্য কোনটি সুইটেবল হবে সেটা নির্ভর করে আপনার চাহিদার উপর। কীভাবে লেদার অথবা ফেব্রিকের মধ্য থেকে একটি পারফেক্ট সোফা বেছে নিতে পারবেন, তা নিয়েই আমরা আজকের আর্টিকেলে কথা বলব।
ফেব্রিক সোফা বনাম লেদার সোফা
বাসার লিভিং রুমে কিংবা অফিসের বসার এরিয়াতে আপনি ফেব্রিকের সোফা বসাবেন নাকি লেদারের সোফা ব্যবহার করবেন সেটা নিয়ে আপনার দ্বিধা থাকতেই পারে। তাই এখানে আমরা দুই ধরনের সোফার ভাল মন্দ দিকগুলো নিয়ে কথা বলব যা আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে।
আরামপ্রদতা
সারাদিনের কর্মব্যস্ততা শেষে আমরা প্রথমেই যেখানে শরীর এলিয়ে দেই সেটা হচ্ছে সোফা। আবার অনেকের কাছে, সোফায় বসে সকালবেলার চায়ে চুমুক দেয়াটাই দিনের অন্যতম সুখের মুহূর্ত। তাই যে সোফাটি কিনতে চাচ্ছেন সেটি আপনার জন্য কতখানি কমফোর্টেবল হবে সেটা নিয়েই বেশি অ্যাটেনশন দিতে হবে। যদি লম্বা সময় কমফোর্টেবল একটি সিটিং স্পেস চান, সেক্ষেত্রে লেদারের চেয়ে ফেব্রিকের সোফাই বেটার অপশন। কারণ, ফেব্রিকের তুলনায় লেদার বেশি তাপ শোষণ করে, তাই কিছুক্ষণ বসলে সোফাটি গরম হয়ে যায়। কিন্তু ফেব্রিকের উপর দীর্ঘ সময় বসে থাকলেও তা লেদারের মত গরম হয়না। তাই বাসার হ্যাপি অ্যাক্টিভিটিজ যেমন পরিবারের সবার সাথে আড্ডা দেয়া, মুভি দেখা কিংবা গেস্ট আসলে তার বেডিং সলিউশন হিসেবেও ফ্যাব্রিকের সোফাই বেশি উপযুক্ত। কিন্তু আপনি যদি অফিসের ওয়েটিং জোন কিংবা রিসিপশনে সোফা রাখতে চান যেখানে মানুষ কম সময়ের জন্য বসবে, সেখানের জন্য লেদার সোফাই আইডিয়াল চয়েজ।
মেন্টেইন্যান্স
আরামের কথা ভেবে যদি ফেব্রিকের সোফা কিনতে চান, তাহলে এর প্রতি আপনাকে কিছুটা যত্নবান হতেই হবে। এ ধরনের সোফার সিটিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে সাধারণত সুতি, তুলো, লিনেন ও সিন্থেটিক ব্যবহার করা হয়। এসব ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি সোফা সহজেই ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করা যায়, ফলে এগুলো ম্যান্টেইন করা খুব একটা কঠিন নয়।। এছাড়াও ফেব্রিকের সোফা পরিষ্কার করার সরঞ্জাম খুব সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, তাই আপনাকে এগুলো খোঁজার জন্যও বেশি সময় ব্যয় করতে হবে না। আপনি চাইলে খুব স্বল্পব্যয়ে সাধারণ মানের ডিটারজেন্ট এবং একটি স্পঞ্জ ব্যবহার করেও এগুলো পরিষ্কার করতে পারেন। কিন্তু আপনার যদি নিয়মিত সোফা পরিষ্কার করার সময় না থাকে, কিংবা আপনি পরিষ্কার করার এতসব ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চান, তাহলে লেদারের সোফা নিতে পারেন। সত্যি বলতে, চামড়া বা লেদারের তৈরি সোফার ক্ষেত্রে এত ধোয়া-মোছা বা রক্ষণাবেক্ষণের ঝামেলা নেই। কেবল নিয়মিত কাপড় দিয়ে মুছে দিলেই যথেষ্ট। তাই লেদার নাকি ফেব্রিকের সোফা আপনার কোনটা বেছে নেয়া উচিত, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে ঘরের চমৎকার এই আসবাবটি রক্ষণাবেক্ষণে আপনি কতটা সময় ব্যয় করবেন তার উপর।
হেলথ কনসার্ন
সোফার মত একটা ভ্যালুয়েবল ফার্নিচারের ম্যাটেরিয়াল সিলেকশনে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকেও মনোযোগী হতে হবে। আপনি বা আপনার কোন ফ্যামিলি মেম্বার যদি অ্যালার্জিক হয়ে থাকেন, তাহলে ফেব্রিকের চেয়ে লেদারের সোফাই আপনার জন্য ভালো হবে। কারণ, ফেব্রিকের সোফায় ধুলো ময়লা ও অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী ধূলিকণা ও জীবাণু জমে, যা অ্যালার্জি বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, আপনার বাসায় কেউ যদি বেশি ঘাম-প্রবণ হয় তাহলে আবার ফেব্রিকের সোফা ভাল হয়। স্বাস্থ্যবান মানুষজন লেদারের সোফায় বেশি সময় বসলে গরমের কারণে সহজেই ঘেমে যেতে পারেন। তাই তাদের কথা চিন্তায় রেখে লেদারের চেয়ে ফেব্রিকই ভাল হবে।
ডিউরেবিলিটি
ফেব্রিকের সোফা ব্যবহারের একটি বড় অসুবিধা হল, অতিরিক্ত ব্যবহারে এটি ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ভালো মানের ফেব্রিকের সোফা আপনার ঘরে নিশ্চিন্তে অনেক বছর টিকে যাবে। তারপরেও এ ধরনের সোফায় দাগ তোলা বেশ কষ্টসাধ্যে। ফলে, অসাবধানতা বশত অসংখ্য দাগ পড়ে গেলে, অনেকটা বাধ্য হয়েই কয়েক বছর পর আপনাকে সোফাটি বদলে নিতে হবে। অন্যদিকে, লেদারের সোফার দাগ অথবা স্টেইন প্রতিরোধী ক্ষমতা বেশি। তাই একটি ফেব্রিক সোফা অপেক্ষা একটি লেদারের সোফা থেকে দাগ মুছে ফেলা অনেক সহজ। আবার ফেব্রিকের চেয়ে লেদারের ডিউরেবিলিটি ও বেশি। তাই যারা দীর্ঘসময় ধরে একই ফার্নিচার ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য লেদারের সোফাই বেস্ট অপশন। কিন্তু যারা এটা পছন্দ করেন না, তারা নির্দ্বিধায় বেছে নিতে পারেন ফেব্রিকের সোফা।
ডিজাইন
নিঃসন্দেহে লেদারের সোফা ব্যবহারে এক ধরনের আভিজাত্য ফুটে, তাও আবার বেশ মিনিমাল লেভেলে। তাই, ড্রয়িং রুমে অভিজাত ভাব ফুটিয়ে তুলতে আপনি লেদারের সোফাকে বিবেচনায় রাখতেই পারেন। কিন্তু লেদারের একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে এর কালার ভ্যারিয়েশন খুবই সীমিত। তাই, রং, রূপ আর নান্দনিকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে ফেব্রিকের সোফাকেই আপনার বেছে নিতে হবে। কারণ এ ধরনের সোফা বিভিন্ন প্যাটার্ন ও রঙের হয়ে থাকে যা আধুনিক ইন্টেরিয়র ডিজাইনে বিভিন্ন স্টাইল এর সাথে চমৎকার মানিয়ে যায়। কালারের পাশাপাশি যে ধরনের প্রিন্ট চান, সেটিও বেছে নেয়ার সুযোগ থাকে।
বাজেট
ঘরের সোফাটি লেদারের হবে নাকি ফেব্রিকের হবে সেটা বহুলাংশে নির্ভর করে বাজেটের উপর। এক্ষেত্রে আমরা যদি ফেব্রিক আর লেদারের মধ্যে তুলনা করি, তাহলে গুণগত মানসম্পন্ন লেদারের চাইতে ফেব্রিকের মূল্যটা বেশ কম। তাই বাজেট ফ্রেন্ডলি আসবাব হিসেবে বেছে নিতে পারেন ফেব্রিকের সোফা। অন্যদিকে আপনার যদি বাজেট ইস্যু না থাকে তাহলে লেদারের সোফা দেখতে পারেন।
উপরিউক্ত আলোচনায় দেখা যায় যে, লেদারের চেয়ে ফেব্রিকের সোফাই সব দিক বিবেচনায় সেরা। উপরে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও, ফেব্রিকের সোফার আরো কিছু বেনিফিটস রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, চাইলেই এই সোফার কাভার পরিবর্তন করা যায়, যা লেদারের সোফাতে সম্ভব নয়। মডার্ন জেনারেশনের যারা ঘরের লুক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন তারা বছর খানেক পর পর ঘরের ইন্টেরিওরে পরিবর্তন নিয়ে আসেন। সেক্ষেত্রে, লিভিং রুমের সাথে মিল রেখে চাইলে সহজেই সোফার ফেব্রিক ও কালার পরিবর্তন করা সম্ভব।
ফেব্রিকের সোফা কেমন হওয়া উচিত?
ফেব্রিকের সোফার সাধারনত দুই ধরনের ক্যাটাগরি আছে – ন্যাচারাল এবং সিনথেটিক। যেহেতু সোফা কেনার প্রাইম কন্ডিশন হচ্ছে আরাম বা কম্ফোর্ট, তাই এই ফেব্রিকের উপর সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে।
ন্যাচারাল ফেব্রিক
ন্যাচারাল ফেব্রিক হলো যারা একটু বেশি কমফোর্টেবল এবং সফট ম্যাটেরিয়ালের মধ্যে সোফার সিটিং কভার ম্যাটেরিয়াল চান তাদের জন্য। ন্যাচারল ফেব্রিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো –
- কটন – দামে সাশ্রয়ী এবং সর্বাধিক প্রচলিত ন্যাচারাল ফাইবার।
- সিল্ক – বেশ এক্সপেনসিভ এবং এলিগ্যান্ট ফেব্রিক। এর ক্লিনিং প্রসেস অনেক সতর্কতার সাথে করতে হয় নাহলে ফেব্রিক নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
- উল – কোয়ালিটি সম্পন্ন লং লাস্টিং ম্যাটেরিয়াল। বছরের পর বছরে রেগুলার ইউজ করলেও অক্ষুণ্ন থাকবে।
- লিলেন – বর্তমান সময়ের ট্রেন্ডি ন্যাচারাল ফেব্রিক ম্যাটেরিয়াল। প্রিন্ট এবং টেক্সচার ভ্যারিয়েশনের কারণে ক্রেতাদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয়।
সিনথেটিক ফেব্রিক
ন্যাচারাল ফেব্রিকের প্রসেস করে অথবা কেমিক্যাল থেকে এই সিনথেটিক ফাইবার তৈরি করা হয়। এই ফেব্রিক থেকে তৈরি ফার্নিচার দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং এটি পরিষ্কার করাও বেশ সহজ।
সিনথেটিক ফেব্রিকের মধ্যে আছে –
- পলিস্টার – অন্যান্য ফেব্রিকের সাথে ক্যামিক্যাল মিক্সিং করে এটি তৈরি করা হয়, তাই এটি বেশ টেকসই।
- নাইলন – পলিস্টারের মত এটিও একইভাবে ক্যামিক্যাল ও অন্যান্য ফাইবারের মিক্সচার করে বানানো হয়।
- এক্রেলিক – আপনার বারান্দা বা রুফটপের সিটিং এরেঞ্জম্যান্টের জন্য এক্রেলিক ফেব্রিক বেস্ট।
- রেয়ন – সিল্ক, কটন আর লিলেনের মিশ্রণে তৈরি অসাধারণ একটি ফেব্রিক হল রেয়ন। আধুনিক ফার্নিচার তৈরির ক্ষেত্রে রেয়ন এখন বহুল ব্যবহৃত।
মানসম্মত ফেব্রিক সোফা কোথায় পাবেন?
যেহেতু ফেব্রিক সোফা আজকাল সর্বত্র সমাদৃত, সেহেতু দেশীয় বেশ কিছু কোম্পানি নিত্য নতুন ডিজাইনের ফেব্রিক সোফা তৈরি করছে। ফার্নিচার কিনলে ব্র্যান্ডেড দোকান থেকেই কেনা উচিত কারণ, ব্র্যান্ড হচ্ছে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা। তাই দেশি-বিদেশি যেকোনো স্বনামধন্য ব্র্যান্ড থেকেই আসবাব কেনার পরামর্শ রইল। দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে নামকরা ব্র্যান্ড হলো হাতিল। হাতিলের প্রতি ব্র্যান্ডের প্রতি সবসময়েই মানুষের আস্থা আছে। হাতিল প্রতিনিয়ত পণ্যের গুণগত মান ও নকশার উন্নতির জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে।