বয়স বাড়ার বিষয়টি ভীষণ চিরন্তন ও সর্বজনীন। জীবনের সোনালি দিনগুলো পেরিয়ে বয়সে, অভিজ্ঞতায় একসময় বৃদ্ধ হতে হয় মানুষকে। প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর ১ অক্টোবর পালিত হয় আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। আমাদের অনেকের বাড়িতেই দাদা-দাদি, নানা-নানি, প্রবীণ মা-বাবা বা আত্মীয় রয়েছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁদের অনেকের শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে শরীর। কারো কারো শরীরে বাসা বাঁধে বিভিন্ন রোগ। বয়স হলে এই ব্যাপারগুলো খুবই স্বাভাবিক। তাই তাদের প্রয়োজন হয় একটু বাড়তি যত্নের, বাড়তি আরামের। আমাদের নিজেদের এই ব্যাপারগুলো খেয়াল করার পাশাপাশি ঘরে তাদের সুবিধামতো সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। ঘরকে কীভাবে প্রবীণদের উপযোগী করে তোলা যায়, সে রকম কয়েকটি উপায় জেনে নেওয়া যাক আজ।
আরামদায়ক আসবাব
প্রবীণদের সর্বোচ্চ আরাম নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সুবিধাজনক আসবাব। তাদের জন্য প্রতিটি আসবাব বাছাইয়ের সময় তাঁদের সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বয়স হলে বিছানা থেকে ওঠা-বসাটা একটু কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই খাট কিনতে হবে মাপমতো। যেন খুব উঁচুও না হয়, আবার খুব নিচুও না হয়ে যায়। খাটে বসে পায়ের পাতা যেন মেঝেতে লেগে থাকে, এমন খাটই ব্যবহার করতে হবে। আগে থেকেই ঘরে উঁচু খাট থাকলে খাটের পাশে আলাদা টুল বা মোড়া রাখতে হবে, যেন সহজেই ওঠানামা করা যায়। খাট নিচু হলে তোশক বা ম্যাট্রেস দিয়ে উঁচু করে দিতে হবে। খাটের ম্যাট্রেসটাও নির্বাচন করতে হবে আরামদায়ক। খুব বেশি শক্ত কিংবা খুব বেশি নরম ম্যাট্রেস ব্যবহারে মাংসপেশির ক্ষতি হতে পারে। আলমারি, ওয়ার্ডরোব ইত্যাদি ব্যবহারে যেন সুবিধা হয় সে জন্য দরজা ও ড্রয়ারে হাতল লাগিয়ে দিলে ভালো। ঘরের দরজায়ও নবের বদলে হাতল ব্যবহার সুবিধাজনক। তা ছাড়া বসার জন্য কুশনিং চেয়ার বেশ আরামদায়ক।
হাতের কাছে সবকিছু
সবকিছুর হাতের কাছে রাখতে খাটের পাশে রাখতে পারেন বেডসাইড টেবিল
বয়স হলে আগের মতো সহজে চলাফেরা করার পরিস্থিতি থাকে না। তাই তাঁদের সব প্রয়োজনীয় জিনিস যেন হাতের কাছে থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য বিছানার পাশে রাখা যেতে পারে একটি বেডসাইড টেবিল। ঘড়ি, চশমা, পানির জগ, গ্লাস ইত্যাদি বেডসাইট টেবিলে রাখলে সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। টেবিলে ড্রয়ার থাকলে সেখানে সহজেই প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো গুছিয়ে রাখা যাবে। বেডসাইড টেবিলটির উচ্চতা যেন খাটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। পছন্দের বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন রাখার জন্য একটি ফ্লোটিং শেলফের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী যেন সহজে খুঁজে পাওয়া যায় সে জন্য সেগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। বিছানার পাশে ফ্যান-লাইটের সুইচবোর্ড লাগানোটা সুবিধাজনক। তা সম্ভব না হলে রিমোট কন্ট্রোলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সিঁড়ি ও মেঝেতে সুরক্ষা
যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সিঁড়ি ও মেঝের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মেঝে খুব বেশি পিচ্ছিল হওয়া যাবে না। অনেক সময় অসাবধানতাবশত হাঁটতে গিয়ে পিছলে পড়লে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মেঝেতে এমন কার্পেট ব্যবহার করতে হবে যেন সহজে পিছলে না যায়। তা ছাড়া মেঝেতে কোনো ফাটল বা অসমতল থাকলে দ্রুত মেরামত করতে হবে। ঘরের আসবাবগুলো এমনভাবে পাততে হবে যেন সহজে হাঁটাচলা করা যায়।
সিঁড়ির একপাশে রেলিং থাকলেও বয়স্ক মানুষের জন্য সেটি যথেষ্ট হয় না। তাই সম্ভব হলে অন্য পাশের দেয়ালে একটি মজবুত রেলিং লাগিয়ে দিতে হবে। এতে সিঁড়িতে ওঠানামার কষ্ট খানিকটা কমবে। অনেক সিঁড়ির ধাপে ধাতব পাত লাগানো থাকে। সেগুলো পা পড়ে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সম্ভব হলে সেগুলো খুলে ফেলাই ভালো।
পর্যাপ্ত আলো
বৃদ্ধ বয়সে প্রায় সবারই দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তাই পুরো ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলো থাকে, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। শোবার ঘরে খাট এমনভাবে রাখতে হবে যেন জানালা দিয়ে যথেষ্ট আলো-বাতাস পাওয়া যায়। তা ছাড়া শোবারঘর, বসারঘর, বাথরুম, করিডর ইত্যাদি স্থানে ৫০-৬০ ওয়াটের এলইডি বাতি ব্যবহার করতে পারেন। ঘর আলোকিত রাখতে একের অধিক বাতি ব্যবহার করতে পারেন। যারা বই পড়েন তাদের সুবিধার জন্য বিছানার পাশে ল্যাম্পশেডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পড়ার টেবিল থাকলে সেখানে সুন্দর একটা টেবিলল্যাম্প রাখা যেতে পারে। তবে বয়স্কদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো ড্রিমলাইট। রাতে ঘুমানোর সময় পুরো ঘর যেন একেবারে গুমোট অন্ধকার না হয়ে থাকে সে জন্য হালকা আলোর ড্রিমলাইট ব্যবহার করতে হবে। এতে রাতের বেলা ঘুম ভেঙে কোথাও যেতে হলে বা কোনো কিছু খুঁজতে হলে অন্ধকারে হাতড়াতে হবে না।
সুবিধাজনক বাথরুম
প্রবীণ ব্যক্তিকে এমন একটি রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে, যেখানে ঘরের সাথে সংলগ্ন বা অ্যাটাচড বাথরুম আছে। নিজের সুবিধামতো যেন বাথরুম ব্যবহার করতে পারে সে জন্য তাদের আলাদা একটি বাথরুম প্রয়োজন। রুমের সাথে বাথরুম না থাকলে এমন একটি রুম তাদের দিতে হবে, যেখান থেকে বাথরুমে যাওয়া-আসা সহজ। বয়স বাড়লে নিচু হয়ে বসাটা যেহেতু অসুবিধা হয়ে পড়ে, তাই বাথরুমে হাই কমোডের ব্যবস্থা করতে হবে। ধরে ওঠা ও বসার জন্য কমোডের কাছে মজবুত একটি হাতল লাগিয়ে দিতে হবে। বয়স্কদের গোসলের সময় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হতে পারে। তাই ধাতব কোনো টুল বা বেঞ্চ বাথরুমে রাখা যেতে পারে। বাথরুম ছোট হলে ফোল্ডিং চেয়ার একপাশে রাখা যেতে পারে। শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ইত্যাদি প্রসাধন আলাদা ধরনের বোতলে রাখতে হবে, যেন সহজেই বোঝা যায়। সম্ভব হলে গরম পানির সুবিধার জন্য গিজার লাগানো যেতে পারে। তা ছাড়া বাথরুম সব সময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে।
খোলামেলা জায়গা
বাড়িতে বড় বারান্দা কিংবা আঙিনা থাকলে রাখতে পারেন সুন্দর একটি দোলনা
ঘরে প্রবীণ কোনো ব্যক্তি থাকলে একটি খোলামেলা জায়গার প্রয়োজন পড়েই। সারাক্ষণ একটা ঘরে থেকে যেন একঘেয়েমি ধরে না যায়, তাই ঘরের কোণে প্রবীণ ব্যক্তিটির জন্য করে দিতে পারেন নিজস্ব একটি স্থান। একটা সুন্দর ও আরামদায়ক ইজিচেয়ার পেতে দিতে পারেন। পাশে একটি ছোট্ট টেবিল রাখতে পারেন। অথবা জানালার পাশে রাখতে পারেন একটি টুলসমেত অ্যাকসেন্ট চেয়ার। সকালে রোদ পোহাতে পোহাতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে বারান্দায় রাখতে পারেন ছোট ক্যাফেটেরিয়া সেট। বড় বারান্দা হলে একটা চমৎকার দোলনা ঝুলিয়ে তাতে বিভিন্ন ধরনের কুশন বিছিয়ে দিতে পারেন আরামদায়ক করার জন্য। বারান্দাটা সাজাতে পারেন ভিন্ন ধরনের ফুল ও পাতাবাহার গাছ দিয়ে। সব মিলিয়ে প্রবীণ ব্যক্তিটির জন্য তৈরি করুন আরামদায়ক পরিবেশ।
প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশিও প্রয়োজন সহানূভুতি ও যত্নের। এই দিকটি সবারই বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। তারা যেন বার্ধক্যের এই সময়টা প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে কাটাতে পারে, সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। ঘরকে প্রবীণদের উপযোগী করে তোলার এই উপায়গুলো আপনার ঘরের জন্য কতটা কার্যকর, তা জানাতে পারেন কমেন্টে।