নব্বইয়ের দশকের গৃহসজ্জা

নব্বইয়ের দশকের বাড়িতে ঢোকার পথ; ছবিসূত্র : পিন্টারেস্ট         

সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ত উঠোন, উঠোন পেরিয়েই চওড়া দু-তিনটা সিঁড়ি দিয়ে বেশ লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দা বেশির ভাগ সময় খোলাই থাকত। বড় বড় পিলার থাকত সিঁড়ির দুই পাশে। পুরো দৃশ্যটাই নব্বইয়ের দশকের বাড়ির কথা মনে করায়। ওই বারান্দাগুলোতে প্রায়ই দেখা যেত লম্বা বেঞ্চ।  স্কুলে বসার বেঞ্চ না কিন্তু, এই বেঞ্চগুলো নকশাদার যেন বারান্দা থেকেই আতিথেয়তার আভাস দিচ্ছে। তখন রোজ বিকেলেই বাড়িতে প্রতিবেশীরা আসতেন। বাড়ির ভেতরে এসে বসার চেয়ে খোলা উঠোন সামনে রেখে বারান্দার বেঞ্চে আড্ডা দেওয়াই তাদের বেশি পছন্দ ছিল।  আড্ডা, হাতে মাখানো মুড়ি আর গরম চায়ে এই বেঞ্চেই কেটে যেত তাদের বিকেল। আবার বাড়ির ছেলেমেয়েরাও স্কুল থেকে ফিরে ঘরে ঢোকার আগে বন্ধুদের সাথে একত্র হতো এই বারান্দায় রাখা লম্বা বেঞ্চটিতেই। এইটুকু থেকেই বোঝা যায় কতটা আলাদা ছিল তখনকার গৃহসজ্জা। আর কতটা আলাদা ছিল জীবনযাপনের ধরন। আজকের লেখা পড়লে হয়তো অনেকের চোখে ভেসে উঠবে ফেলে আসা শৈশব -কৈশোরের ঘরবাড়ি, পুরোনো দিনের আসবাবপত্র ।

আসবাব
পালঙ্ক/ স্ট্যান্ড দেওয়া বড় খাট

নব্বইয়ের দশকের বেডরুমের সাজ। ছবিসূত্র : পিন্টারেস্ট 

তখন সব বাড়িতেই প্রায় ভারী কারুকাজের বিশাল পালঙ্ক বা স্ট্যান্ডঘেরা খাট দেখা যেত। অমন খাট জরুরিও ছিল বটে। একান্নবর্তী পরিবার, বাড়িভর্তি পরিবারের বিভিন্ন বয়সী সদস্য, আত্মীয়দের নিয়মিত আসা-যাওয়া, গ্রাম থেকে চাকরি বা চিকিৎসার জন্য শহরে আসা পরিচিতদের ভিড়নব্বইয়ের দশকের জীবনযাত্রায় এসব ভীষণ পরিচিত দৃশ্য। তাই তিন, চার বোন মিলে হয়তো একটি ঘরেই ঘুমাতেন। অথবা দাদা-দাদির সাথে ঘুমাত চার-পাঁচজন নাতি-নাতনি। এসব ভেবেই বড় আকারে খাট বানানো হতো।

আর খাটের চারপাশে স্ট্যান্ড রাখার কারণ ছিল মশারি টাঙানো। স্ট্যান্ড থাকায় আলাদা হুক দেয়ালে না আটকেই মশারি টাঙানো যেত। এই খাটগুলো কিন্তু এখনকার খাটের তুলনায় অনেকখানি উঁচু ছিল। এতটাই যে খাটে উঠতে টুল ব্যবহার করতে হতো, এই টুলগুলো বানানো হতো বক্সের মতো, যেখানে রাখা হতো নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। আবার খাটের নিচের বড় ফাঁকা জায়গা ব্যবহার করা হতো পিঁয়াজ, রসুন, হলুদের স্টোরেজ হিসেবে। তখন মৌসুমে ফসল কিনে সারা বছর ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল, এখনকার মতো দোকানে সব সময় সবকিছু পাওয়া যেত না। আর এই যে বিশাল উঁচু উঁচু খাট/ পালঙ্ক এগুলো কিন্তু এখনকার ঘরে রাখা সম্ভব না, কারণ এখন আমাদের সিলিং থাকে বেশ নিচুতে। একটা সময় বিদ্যুতের এত সহজলভ্যতা ছিল না, তাই সবার বাসায় ফ্যান থাকত না, এ জন্য সিলিং করা হতো অনেকখানি উঁচুতে, আবার ছাদেও দেওয়া হতো জলছাদ। যেন ভেতরে গরম কম হয়। এখন আমাদের বিদ্যুৎ হয়েছে সহজলভ্য, কমেছে সিলিংয়ের উচ্চতা । আর পরিবারও ছোট, সবার জন্য আলাদা ঘর, আসবাবপত্র থাকাই এখন রেওয়াজ। আর তাই এই বড় পালঙ্কের প্রয়োজন আসলে ফুরোচ্ছে। বরং খাটের নিচে প্রয়োজনীয় জিনিস স্টোর করার জন্য এসেছে আরও আধুনিক উপায়। হাতিলেই আমরা পাচ্ছি স্টোরেজসহ খাট। স্টোর করাকে আরও দৃষ্টিনন্দন করতে আছে ড্রয়ারসহ খাটও। স্টোরেজসহ খাটের মাঝে হাতিলে বেশ কিছু ডিজাইন পাওয়া যাবে, এর মাঝে Sublime-180, Thrill-162, Mirage-175, Idyll-152 পাওয়া যাবে, আর সাথে আরও অনেক ডিজাইন তো থাকছেই।

আলনা

নিত্যব্যবহারের কাপড়গুলো রাখার জন্য আলনা ব্যবহার করত। এখন আর এর প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। এই আলনাগুলোর নিচে থাকত জুতা রাখার জায়গা । আলনাও বহুমুখী কাজেই ব্যবহৃত হতো। আলনার বদলে আমাদের ঘরে জায়গা নিয়েছে কোট হ্যাঙ্গার। যেখানে রাখা যায় রোজ পরার মতো টি-শার্ট, শার্ট, ট্রাউজার। আবার জুতা রাখার জন্যও আর আলনার প্রয়োজন নেই, সুন্দর সুন্দর শ্যু র‍্যাকে জুতা রাখা যায়, গুছিয়ে আর পরিচ্ছন্নভাবেও, এই আসবাবটি ঘরেও যোগ করে নতুন মাত্রা।

ছাপবাক্স

এই বাক্সটার নাম সম্ভবত একেক এলাকায় একেক রকম৷ নব্বইয়ের দশকের প্রায় প্রতি ঘরেই এমন বাক্স ছিল। রাখা হতো লেপ, কম্বল, বালিশ। অতিথিদের জন্য বাড়তি বালিশ রাখতেও ছাপবাক্স ব্যবহৃত হতো। আর সারা বছর শীতের লেপ, কম্বল সংরক্ষণ করার জন্যও এটি ছিল বেশ উপযোগী ।

জলচৌকি

এই আসবাবটি এখন একেবারেই নেই। এর বদলে ঘরে এসেছে ডিভান বা কাউচ। এই আসবাবটির উচ্চতা অন্যান্য আসবাবের চেয়ে কম ছিল। কেউ এটি নামাজ পড়তে ব্যবহার করত। কেউ আবার পানের বাটা খুলে এখানেই করতেন অতিথি আপ্যায়ন।

সাজসজ্জা
ঐতিহ্যবাহী উপকরণ 

নব্বইয়ের দশকে অভিজাত বাড়ির বসার ঘর যেমন হতো। ছবিসূত্র : গুগল               

ঘর সাজানোর একটা বড় বিষয় ছিল কুশিকাঁটার বুননে তৈরি নকশি কাপড়। এমন কাপড় দিয়ে আসবাব ঢেকে রাখা হতো। সেন্টার টেবিল, ডাইনিং টেবিল, ড্রেসিং টেবিলের আয়না, ওয়ার্ডরোবসবকিছুই ঢেকে রাখা হতো কুশিকাঁটার বুননে করা নকশি কাপড় দিয়ে। ঘরের সাজে বেশির ভাগ বাড়ির দেয়ালেই দেখা যেত হরিণের মাথা বা চামড়া। পূর্বপুরুষের কেউ হয়তো সেটা শিকার করেছেন, বা হয়তো কিনে এনেছেন। আবার ঘর সাজাতে ময়ূরের পাখাও অনেক ব্যবহার করা হতো। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রচলন না থাকলেও মানুষ তখন ঘর সাজাতে মূলত মাথায় রাখত প্রয়োজন এবং পারিবারিক ঐতিহ্য।

ঘরের রং

নব্বই দশকের পুরোনো বাড়ির বারান্দা; ছবিসূত্র : পিন্টারেস্ট


বাড়িগুলোর রং হতো কখনো লাল খয়েরি কখনো আবার ধবধবে সাদা। মেঝেতেও একাধিক রং দেখা যেত, কালো আর লাল, কোথাও আবার ধূসর বর্ণ । আবার অনেক বাসার মেঝে হতো মোজাইকের। ভেতরের ঘরের রং হতো অফ হোয়াইট, বা পেস্ট ধরনের, একটু হলুদাভ সাদা। একদম সাদা রং করা হতো না কারণ ধুলোময়লা জমবে বেশি, আবার গাঢ় রং করা হতো না ঘর অনুজ্জ্বল দেখাবে বলে।
এখন অবশ্য দুটো সমস্যারই সমাধান হয়েছে। রঙের ক্ষেত্রেও আমরা এখন  এমন সব রং দেয়ালে দিতে পারছি যাতে ময়লা আটকাবে কম, বা পরিষ্কার করা সহজ। আবার আলোর জন্য আধুনিক লাইটগুলো ব্যবহার করলে ঘরও অনুজ্জ্বল দেখানোর ভয় নেই। তাই এখন এই রংগুলোর ব্যবহারও কমে এসেছে অনেকটা, আর রং ব্যবহারে এসেছে নতুনত্ব।

পর্দা

ঘরের পর্দা তো সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল গৃহসজ্জায়। ফুলেল প্রিন্টের পর্দার প্রচলন ছিল বেশি। সাধারণত সাদা বা অফহোয়াইটের মাঝে বিভিন্ন রঙের ফুলের প্রিন্টের পর্দা দেখা যেত সব বাড়িতে। জানালায় গ্রিলের বদলে তখন ছিল শিক। এই শিক ছিল নিরাপত্তার জন্য।

এই যে নব্বইয়ের দশকের গৃহসজ্জার সাথে বর্তমানের গৃহসজ্জার এত পার্থক্যতা কিন্তু মোটেও অযৌক্তিক নয়। আমাদের পরিবারের কাঠামো বদলেছে, বদলেছে সামাজিক কাঠামো, আর তাল মিলিয়ে পরিবর্তন এসেছে আমাদের চাহিদার ধরনেও। আগে পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছিল সাত থেকে দশজন। তাই বাড়িও ছিল বিশাল, আসবাবও ছিল আকারে বড়। এখন পরিবারের সদস্যসংখ্যা চারকে অতিক্রম করে না বললেই চলে। ছোট ছোট পরিবারগুলোর জীবনও হয় শহরকেন্দ্রিক। সেখানে দুই, তিন কামরার ছোট্ট বাসায় সবার উপযোগী আসবাবের কথা ভাবতে হয়। তাই হয়তো ইদানীং চাহিদা বাড়ছে স্মার্টফিট ফার্নিচারের। পুরোনো সেই দিনগুলোতে হয়তো চাইলেও আর ফেরা সম্ভব না, কারণ আমরা আরও অনেক সহজ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি প্রতিদিন। কিন্তু স্মৃতি হাতড়ে দেখলে ভীষণ ভালো লাগা কাজ করে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।