অন্দরসজ্জা হোক পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই

 বর্তমানে সাসটেইনেবিলিটি বা টেকসই এবং ইকোফ্রেন্ডলি বা পরিবেশবান্ধব শব্দগুলো আমাদের কাছে খানিকটা হলেও পরিচিতি লাভ করেছে। এর কারণ একুশ শতকের এই যুগে যেকোনো কিছু করার ক্ষেত্রেই তার সাসটেইনেবিলিটি বা স্থায়িত্বের মান যাচাই করে নেওয়া কেবল সময়ের দাবি। আর বাড়িঘর তৈরি থেকে শুরু করে বাড়ির অভ্যন্তরীণ নকশাসবকিছুতেই এর স্থায়িত্ব কতটুকু এবং তা পরিবেশের ওপর কতখানি প্রভাব ফেলছে, এসব আগে থেকেই নির্ধারণ করে নেওয়া অতীব জরুরি। সাসটেইনেবল ইন্টেরিয়র ডিজাইন বা পরিবেশবান্ধব বাড়ির অভ্যন্তরীণ নকশা বলতে বোঝায় বাসাবাড়ির নকশায় এমন উপকরণ ব্যবহার করা, যা আমাদের পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব হ্রাস করে প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করবে এবং সেই সাথে এতে স্থায়িত্ব প্রদান করবে। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে বর্তমান পৃথিবী যেখানে একের পর এক হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তাতে করে আমাদের উচিত নিজেদের জায়গা থেকে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে এগিয়ে এসে কাজ করা এবং তা শুরু করা প্রয়োজন নিজেদের ঘর থেকেই।

 

ঘরের প্রতিটি কোনা হোক পরিবেশবান্ধব

যেখান থেকে দিনের শুরু এবং যেখানে গিয়ে দিনের শেষ, যেখানে ক্লান্তি শেষে একটা প্রশান্তির নিশ্বাস নেওয়া যায় তাকেই তো আমরা ঘর বলতে পারি। সেই বাড়ি বা ঘরের ডিজাইন হতে হবে অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন এবং একই সাথে পরিবেশবান্ধব। প্রযুক্তির যুগে আমরা নিজেদের কষ্ট লাঘবে আমাদের বাড়ি ঘরে এমন অনেক কিছুই ব্যবহার করে থাকি, যা একই সাথে আমাদের শরীর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। প্রকৃতির স্পর্শ, সবুজের ছোঁয়া থাকলে তা যে কেবল ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়, তা নয়, সেই সাথে শরীর ও মনকেও সতেজ রাখে। তাই বাড়ির অভ্যন্তরীণ নকশা করতে গেলে আমাদের নিজেদের সুবিধার কথা চিন্তা করার পাশাপাশি অবশ্যই পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করা প্রয়োজন। 

 বাড়ির অভ্যন্তরীণ নকশা পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই করতে যা যা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে :

শক্তির সঠিক ব্যবহার

সাসটেইনেবলিটির কথা বললেই শক্তিকে সঠিক এবং যথাযথ ব্যবহারের প্রসঙ্গ শুরুতেই চলে আসে। তা করতে গেলে আমাদের সর্বপ্রথম যা করা উচিত তা হলো প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে প্রাকৃতিক উপায় খুঁজে বের করা। আমাদের বাসাবাড়ি তৈরি থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় পর্যন্ত অত্যাধুনিক লাইট, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশন ইত্যাদির ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে শক্তির ক্ষয় হয়। আর তাই পরিবেশবান্ধব ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মূলনীতিই হলো এসবের ব্যবহার কমিয়ে আনা। ঘরবাড়ির ইন্টেরিয়র ডিজাইনে গ্রিন টেকনোলজির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে জানালা বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা রাখা উচিত। দরজা-জানালা দিয়ে যেন সঠিকভাবে বাতাস চলাচল করতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এতে করে দিনের বেলায় লাইট এবং ফ্যানের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। লাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলইডি লাইট ব্যবহার করা উচিত, যা ৭৫% শক্তি অপচয় রোধ করে থাকে। অনেক সময় আমরা অযথাই ঘরের লাইট-ফ্যান অন করে রাখি কিংবা কখনো ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অফ করতে ভুলে যাই। এতে করেও অপচয় হয়, যেদিকে আমাদের বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।  

আলো-বাতাসের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে ঘরে বড় জানালা।

পরিবেশবান্ধব আসবাবপত্র বা অর্গানিক ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার বৃদ্ধি

আমাদের ঘরবাড়িজুড়ে সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করে যা থাকে তা হলো আসবাবপত্র। তাই আসবাবপত্র নির্বাচনে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন আসবাবপত্র বানানো বা কেনার ক্ষেত্রে উপাদান হিসেবে কাঠ বা পাথরকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। এসব উপাদান দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি এরা তাপ সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে। শুধু তা-ই নয়। কাঠের গুণগত মান যাচাইয়েও লক্ষ রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রে এর ম্যাটেরিয়াল বা উপাদান সম্পর্কে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।  অপর দিকে বাঁশ বর্তমান সময়ে আসবাবপত্রে ব্যবহারের অন্যতম উপাদান। বাঁশ সহজেই প্রতিস্থাপন করা যায় এবং এটি একটি নবায়নযোগ্য উপাদান। তাই আসবাবপত্রে বাঁশের ব্যবহার হতে পারে অন্যতম পরিবেশবান্ধব উদাহরণ, যা দৃষ্টিনন্দন টেকসই আসবাবপত্রে পরিণত করা যেতে পারে। তবে ঘরের মধ্যে অতিরিক্ত আসবাবপত্রের ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে করে ঘরে আলো-বাতাসের পরিমাণ যেমন কমে যায় তেমনি ঘরের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়। এমনকি অতিরিক্ত আসবাবপত্রের কারণে ঘরকে এলোমেলোও দেখায়। 

আসবাবপত্র হোক কাঠের 

ঘর হোক সবুজময়

আমাদের অনেকেরই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বাড়ির ভেতরে। আবার অনেকে সারা দিনের ব্যস্ততা সেরে বাসায় ফেরে৷ তাই বাড়ির ভেতরের পরিবেশ যেন স্বাস্থ্যকর থাকে, তা নিশ্চিত করা ইন্টেরিয়র ডিজাইনের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে শখের বসে ইনডোর প্ল্যান্ট বা বাসাবাড়িতে গাছ লাগাতে অনেককেই দেখা যায়। তবে ঘরের ভেতরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এটি কেবল শখের অংশ হিসেবে না নিয়ে প্রয়োজনীয় অংশ হিসেবেই জোর দেওয়া উচিত। ঘরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্ট যেমন স্নেক প্ল্যান্ট, ক্যাকটাস, প্যাথোস ইত্যাদি দিয়ে সাজানো যেতে পারে। এতে যেমন ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় তেমনি মানসিক বিকাশে, স্ট্রেস কমাতে এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন সংগ্রহে সাহায্য করে থাকে। তবে অবশ্যই বাগান করার ক্ষেত্রে এর সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জেনে নেওয়া উচিত।

বিভিন্ন ইনডোর প্লান্ট দিয়ে সাজানো যায় ঘরের কোনায় 

 সঠিক রঙের ব্যবহার

বাসাবাড়ির দেয়ালের রং আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রং নির্বাচন এবং রঙের উপাদান দুটি বিষয় সম্পর্কেই আমাদের একটু জেনে নিতে হবে। তুলনামূলক হালকা রং ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে সেই সাথে তাপ শোষণ করে থাকে। এতে ঘরের মধ্যে এক ধরনের স্নিগ্ধতা বিরাজ করে। শুধু তা-ই নয়। হালকা রঙের কারণে ঘরকে তুলনামূলক বড় বলেও মনে হয়। আবার অনেক সময় কিছু রং ব্যবহার করা হয়, যা আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসব রং ব্যবহারের আগে দেখে নেওয়া প্রয়োজন যে তা আসলে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য সঠিক এবং পরিবেশবান্ধব কি না। তাই রং নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন রং বেছে নিতে হবে, যাদের ওপরে “Low Odor/VOC” লেখা থাকবে এবং যা অ্যাসিটোন ও ফর্মালডিহাইডমুক্ত থাকবে।

পর্দায় থাকুক শুভ্রতার ছোঁয়া 

ঘরের দেয়ালের রং হোক হালকা এবং স্বাস্থ্যকর

 তিনটি আর-এর সমষ্টি/ রিইউজ, রিডিউজ এবং রিসাইকেল

বিশ্বজুড়ে থ্রি আরস ফ্রেমওয়ার্ক এখন খুবই জনপ্রিয় একটি বিষয়। থ্রি আরস ফ্রেমওয়ার্ক হলো রিইউজ, রিডিউজ এবং রিসাইকেলের সমষ্টি। বাসাবাড়ির ইন্টেরিয়র সাজানোতে তিনটি জিনিসের সমন্বয় খুবই জরুরি।

প্রথমত, যেকোনো জিনিসের অতিরিক্ত ব্যবহারের বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শুধু তা-ই নয়। অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর জিনিসের ব্যবহার কমানোর বিষয়েও লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এর সাথে সাথে যেকোনো জিনিস একবার ব্যবহার করে তা ফেলে দেওয়া উচিত নয়। রিসাইকেলিংয়ের বিষয়টি এখন আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। ভেঙে যাওয়া ফেলে দেওয়া জিনিসকে চাইলেই একটু মাথা খাটিয়ে অন্যভাবে আমরা ব্যবহার করে থাকতে পারি। সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। এতে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে, সেই সাথে সৃজশীলতাও প্রকাশ পাবে।

 অনেকভাবেই পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই উপায়ে বাড়িঘরের ইন্টেরিয়র সাজানো যায়। চাইলে আরো নানা সৃষ্টিশীল উপায়ে করা যেতে পারে। বাড়িঘরের অভ্যন্তরীণ নকশা সাজানোর আর কী কী পরিবেশবান্ধব উপায় আপনার মাথায় ঘুরছে, তা এখনই জানিয়ে দিন আমাদের।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।