গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বলেছিলেন, “একমাত্র জিনিস যা ধ্রুবক তা হল পরিবর্তন।” এই বক্তব্যটি তখনকার মতো আজও সত্য। বিশেষত টেকসই জীবন ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পরিবর্তন জরুরি। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান পরিবেশ সচেতনতার সাথে পাল্লা দিতে কোম্পানিগুলো তাদের পরিবেশগত প্রভাব পরিবর্তন এবং হ্রাস করার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ফার্নিচার শিল্পও এর থেকে আলাদা নয়।
পরিবেশ নিয়ে যখন ভাবনার উদয় হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে ‘টেকসই উন্নয়ন’ শব্দটি। যে উন্নয়ন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়ন চাহিদার কোনো ধরনের ক্ষতি না করে বর্তমান উন্নয়ন চাহিদা পূরণ করতে পারে, সে ধরনের উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়ন বলা হয়ে থাকে।
পরিবেশের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন ভাবনাটির গুরুত্ব বেশি, কারণ টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমেই পরিবেশ থেকে যেসব কাঁচামাল নিয়ে পণ্য তৈরি হয় তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। ফার্নিচার শিল্পও টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে পরিবেশ ভাবনার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ডিজাইন দিয়ে শুরু
একটি কোম্পানি যখন টেকসই পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু করে, তখন শুরুতেই ভাবনার প্রতিফলন ঘটে ডিজাইন প্রক্রিয়ায়। একটি সাধারণ নকশা যা স্বল্প কিন্তু টেকসই এবং উচ্চ-মানের উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি সম্ভব এবং যা উৎপাদন করতে কম শক্তির খরচ হয় সেটিতেই মনোযোগ থাকা উচিত প্রতিষ্ঠানের যা একটি টেকসই পণ্যের ভিত্তি স্থাপন করতে সাহায্য করে। রুচিশীল এবং একইসঙ্গে টেকসই ডিজাইন ফার্নিচার শিল্পের জন্য বড় চ্যালেন্জ হলেও এটি নিয়ে প্রতিনিয়তই কাজ হচ্ছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই।
কোনো একটি ফার্নিচার যখন বাজারে আসে তখন সেটির প্রতি গ্রাহক পর্যায়ে শুরুতে আগ্রহ সৃষ্টি হয় ডিজাইন দেখেই। তাই ডিজাইন যেমন হতে হবে আকর্ষণীয়, তেমনি থাকতে হবে পরিবেশগত ভাবনার প্রতিফলন। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে হাতিলের মত প্রথম সারির ফার্নিচার ব্র্যান্ডগুলো এই জায়গায় অনেকদিন ধরেই কাজ করছে, চেষ্টা করছে টেকসই উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় ডিজাইনের মেলবন্ধন তৈরিতে। হাতিল কর্তৃপক্ষ বলছিল, প্রতিষ্ঠানটি বুদ্ধিমান নকশা, সংরক্ষণ এবং পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপের পরিবেশগত প্রভাব কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে প্রতিটি নকশা যত্ন সহকারে গঠন, এনার্জির ব্যবহার এবং স্থায়িত্বকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।
ফার্নিচার নকশায় থাকুক পরিবেশের ভাবনা। ছবি : Gulliver-101
কাঁচামাল ও উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সচেতনতা
যখন একটি ব্র্যান্ড পণ্যের ডিজাইন নিয়ে কাজ করে তখন একইসাথে পণ্য তৈরির কাঁচামালও তার ভাবনায় অনুরণন ঘটায়। এক্ষেত্রে কাঁচামাল নির্বাচনে থাকতে হয় সতর্ক। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যেখানে চ্যালেন্জ জানাচ্ছে টিকে থাকার লড়াইয়ে, সেখানে ফার্নিচার পণ্যের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে গাছের কাঠ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যা পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে প্রশমিত করতে পারে। এক্ষেত্রে হার্ডউড ট্রি যেমন ওক, অ্যাশ, ইলমের মতো গাছের মতো বিকল্প ভাবনা এবং নবায়নযোগ্য কাঁচামাল ব্যবহার করা যেতে পারে। জার্মানভিত্তিক দ্য ফরেস্ট স্টিওয়ার্ডশিপ কাউন্সিলের (এফএসসি) সনদপ্রাপ্ত ওক এবং বিচ ওক কাঠ দিয়ে আসবাব উৎপাদনে উদ্যোগী হয়েছে ফার্নিচার ব্র্যান্ড হাতিল। পরিবেশের ক্ষতি না করে যেসব কাঠ উৎপাদিত হয়, সেগুলোকেই সনদ দেয় এফএসসি। বর্তমানে এফএসসি সনদপ্রাপ্ত কাঠের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বোর্ড ও ইস্পাত ব্যবহার করছে হাতিল। এমনকি তাদের কারখানাটিও এফএসসি সনদপ্রাপ্ত।
একইসাথে পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয় এমন কেমিক্যাল ফার্নিচার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারেও থাকতে হয় সচেষ্ট। এর সাথে শক্তি খরচের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবনায় প্রতিফলন ঘটাতে রিনিউএবল বা নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহারও দেখাতে পারে ইতিবাচক ভবিষ্যত। বাংলাদেশে যেমন হাতিল উৎপাদন প্রক্রিয়ার শক্তির জন্য স্ক্র্যাপ কাঠ এবং কাঠের ধূলিকণা ব্যবহার করে আসছে।
উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমিয়েও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। ছবি : Hatil Factory
প্যাকেজিং ও পরিবহনে গুরুত্ব কতটা?
প্যাকেজিং ভাবনায় সবচেয়ে ভালো হতো যদি প্যাকেজিং-ই না করতে হতো। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানান বিবেচনায় প্যাকেজিং একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ফার্নিচার শিল্পের জন্য। বছরের পর বছর ধরে একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক যেমন স্টাইরোফোম এবং এয়ারব্যাগ আসবাবপত্র প্যাকেজিংয়ের জন্য আদর্শ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে এই ধারায় পরিবর্তন আসছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেইসাথে হালকা জৈব-পচনযোগ্য উপকরণ যা পরিবহনে শক্তির অপচয় এবং ব্যবহারের শেষে প্রাকৃতিক বর্জ্য হ্রাস করে সেটিতেও মনোযোগী হচ্ছে ফার্নিচার কোম্পানিগুলো। প্যাকেজিংয়ে নিশ্চিত করতে হবে, নতুন ফার্নিচার বাড়িতে নিরাপদে পৌঁছানোর পরে প্যাকেজিং উপকরণ পুনর্ব্যবহার বা কম্পোস্ট করা যেন সহজসাধ্য হয়। এক্ষেত্রে কার্ডবোর্ড বক্স, ইকো ফ্রেন্ডলি ট্যাপ, বায়োডিগ্রেডেবল সুতা হতে পারে সহজ সমাধান।
ফার্নিচার পরিবহনের ক্ষেত্রেও কার্বন নির্গমণ ও জ্বালানী ব্যয় কমানোয় মনোযোগী হওয়া এখন পরিবেশ ভাবনার প্রতিফলনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকসই পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে ফার্নিচার পণ্য শহর থেকে শহর কিংবা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরের দেশে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে হাতিলের মতো বৈশ্বিক একটি ফার্নিচার ব্র্যান্ড টেকসই পরিবহন ব্যবস্থায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ বান্ধব ফার্নিচার ক্রয়ের মাধ্যমে গ্রাহক হিসেবে আপনি শুধু নিজের উপকারই করতে পারেন, এমন নয়। উপকার হচ্ছে পৃথিবীরও। সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে যার যার অবস্থান থেকে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার এই প্রচেষ্টা চলুক নিরন্তর।