বাদশাহি আমলে খোদ বাদশাহ কেমন চেয়ারে বসতেন, সেই ব্যাপারে কেই-বা জানতে চাইবে? লেখাটা শুরু করার আগে এমনই ভাবছিলাম। পাঠকও বোধ হয় এমনটাই ভাবছেন। তাহলে উইটল্ড রাইব্যাকজিনস্কির অবস্থাটাই চিন্তা করুন। কানাডিয়ান এই ভদ্রলোক যে শুধু চেয়ারের ইতিহাসের ওপরেই একটি আস্ত বই লিখে ফেলেছেন! তবে বর্তমানে চেয়ার গুলোর ব্যবহার সর্বত্র যা কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মতো এবং বিশেষ করে কাঠের অফিস চেয়ার গুলোর ব্যবহার ব্যাপক।
তবে যতটা একঘেয়ে ইতিহাস হবে ভাবছেন, ততটা বোধ হয় নয়। উইটল্ডের বইতেই আছে অনেক মজার গল্প। এই যেমন, মাত্র দুই শতাব্দী আগেও চেয়ার ব্যাপারটিই ছিল আভিজাত্য এবং নেতৃত্বের প্রতীক। যেকোনো সামাজিক পরিবেশে শুধু নেতৃত্বস্থানীয় লোকজনই বসার অধিকার পেতেন। রাজার প্রতি সম্মান দেখানোর অংশ হিসেবে প্রজাদের হাঁটু মুড়ে বসতে হতো। এই ধারা প্রচলিত ছিল এমনকি রানি ভিক্টোরিয়ার সময় পর্যন্ত। বলা হয়ে থাকে, একবার নাকি রানির এক বিশ্বস্ত ভৃত্য তাঁর সামনে টানা ২৮ ঘণ্টা হাঁটু মুড়ে বসে ছিলেন। এত লম্বা সময় টানা বসে থাকার কারণে সেই ভৃত্যের এতই বাজে অবস্থা হয়েছিল যে তাকে টেনে ওঠাতে প্রায় তিনজন লোককে সাহায্য করতে হয়েছে!
আসবাবপত্র মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুরুতে আসবাব বানানো হতো বাঁচার উদ্দেশ্যে। সময়ের সাথে আসবাবপত্রের ধারণাটি মানুষের আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলুন আমাদের খুবই পরিচিত কিছু আসবাবপত্রের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত কিছু গল্প জেনে আসা যাক।
কাঠের অফিস চেয়ার, সোফা এবং দম্পতিদের জন্য ‘লাভ সিট’
দুজন বসার মতো সোফার আদি নাম “লাভ সিট”
যেই রূপে আমরা এখন সোফা দেখি, সেটা আসলে ঠিক কীভাবে এসেছে, তা খুঁজে বের করা কঠিন। বিশ্বের অনেকগুলো সভ্যতায় সোফা ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। একেক সভ্যতায় একেক উদ্দেশ্যে সোফা ব্যবহার করা হতো। রোমান সভ্যতায় সোফার ব্যবহার ছিল ডাইনিং টেবিলের সাথে চেয়ারের পরিবর্তে। সেখানে শুধু অভিজাত পুরুষেরাই বসতে পারতেন। নারী কিংবা শিশু, কারোই সোফা কিংবা ডাইনিং টেবিল ব্যবহার করার অধিকার ছিল না।
আবার আয়ারল্যান্ড এবং নর্থ আমেরিকার মানুষ যেমন সোফাকে এখনো কাউচ বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। আগে ‘কাউচ’-এর ব্যবহার হতো মূলত একজনের জন্য উপযোগী শোয়ার আসবাব হিসেবে। তবে এখন সেখানেও সোফা কিংবা কাউচকে বসার ফার্নিচার হিসেবেই ব্যবহার করা হয়।
তবে চেয়ারের মতোই সোফাও ছিল মূলত অভিজাতদের আসবাব, তবে এর ব্যবহার এখন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র বাড়িতে কিংবা অফিসে। রাজপরিবার কিংবা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে তখন বিনোদনের উদ্দেশ্যে পারিবারিক গান এবং নাচের অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। গায়ক কিংবা নৃত্যশিল্পী যখন পারফর্ম করতেন, তখন পরিবারের সদস্যদের বসার জন্য ব্যবহৃত হতো সোফা। সোফা গণমানুষের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠা শুরু করে আসলে পশ্চিম বিশ্বে শিল্পবিপ্লবের পরে।
সোফার ইতিহাস ঘাঁটলে সবচেয়ে চমৎকার যেই জিনিসটি খুঁজে পাওয়া যায়, তার নাম ‘লাভ সিট’। ইংল্যান্ডে দুজনের বসার মতো সোফাগুলোকে এখনো অনেকেই লাভ সিট বলে ডাকেন। ‘লাভ সিট’-এর প্রচলন মূলত দম্পতিদের জন্য।
আগের রক্ষণশীল সমাজে তরুণ দম্পতিরা প্রকাশ্যে একে অন্যের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হলে ব্যাপারটিকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হতো না। সে কারণেই লাভ সিটের জন্ম। এই সোফাগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হতো, যাতে দম্পতিরা একে অন্যের পাশে বসতে পারেন। আবার, সোফার প্রশ্বস্ত ডিজাইনের কারণে তাদের খুব ঘনিষ্ঠ হয়েও বসতে হতো না। ফলে সমাজের ভ্রুকুটি থেকে নিজেদের বাঁচিয়েই সামাজিক পরিবেশে একসাথে বসতে পারতেন দম্পতিরা।
বিজ্ঞানী ডারউইনের চাকায় চলা কাঠের চেয়ার
চার্লস ডারউইনের প্রথম অফিস চেয়ার
বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনকে আমরা সবাই বিবর্তনবাদের প্রবর্তক হিসেবেই চিনি। তবে শুধু বিবর্তনবাদ নয়, ইতিহাস তাকে অফিস চেয়ারের আবিষ্কারক হিসেবেও মনে রেখেছে। গবেষণার সময়ে ডারউইনের বারবার রুমের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে অনেক সময় নষ্ট হতো। একদিন তিনি তার কাঠের আর্ম-চেয়ারে নিচে কাঠের তক্তার সাহায্যে কয়েকটি চাকা লাগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। চেয়ার যে চাকায়ও চলতে পারে, এই ধারণার তখনই প্রথম জন্ম।
১৮৫১ সালে সেই ধারণাকে কাজে লাগালেন থমাস ওয়ারেন নামে এক ভদ্রলোক। তিনি আমেরিকান চেয়ার কোম্পানির মালিক ছিলেন। তখন মাত্র শিল্পবিপ্লব ঘটছে। ইংল্যান্ডে রেলের প্রচলন বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেল ব্যবস্থাপনার প্রশাসনিক দপ্তরগুলো। এই দপ্তরগুলোর স্টাফরা টিকিট বেচাকেনা কিংবা অন্যান্য কাজ যাতে আরো দ্রুত করতে পারেন, সেই চিন্তা থেকেই থমাস ওয়ারেনের কোম্পানি অফিস চেয়ার নামে একটি আলাদা ধরনের চেয়ার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরেই প্রচলিত হওয়া শুরু করে অফিস চেয়ার। এরই পথ ধরে হাতিল ফার্নিচার বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে দুর্দান্ত সব অফিস চেয়ার এর মডেল গুলো যা অফিস প্রাঙ্গন গুলো আরো বেশি সুশোভিত করে।
বিছানা ছিল ঘাসের
এখন আর তেমন দেখা যায় না। তবে আমাদের অনেকেই ছোটবেলাতেও চৌকির ব্যবহার দেখেছি। কাঠের পায়া দিয়ে তৈরি এসব চৌকি-ই আসলে বিছানার আদিরূপ। আমাদের উপমহাদেশীয় অঞ্চলে এখনো অনেক জায়গায় চৌকির ব্যবহার দেখা যায়।
অভিজাত শ্রেণির মানুষের বিছানা অবশ্য অনেক আগে থেকেই কাঠ কিংবা নানা ধরনের ধাতুর তৈরি করা হতো। এমন বিছানার নজির প্রথম দেখা যায় গ্রিক এবং রোমান সভ্যতায়। তখন সোনা এবং রুপার ব্যবহারে রাজাদের বিছানা বানানোর প্রচলন ছিল। মিসরের ফারাওদের পিরামিডেও এমন বিছানা দেখা গেছে।
তবে মানুষ বিছানা ব্যবহার করে আরো অনেক আগে থেকে। এই মাত্র গত বছরের আগস্টেই ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো বিছানার নমুনার সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তবর্তী গুহাগুলো পর্যবেক্ষণ করা বোঝা গিয়েছে, বিছানা মানুষের সঙ্গী ২০০ হাজার বছর ধরে। গুহামানবের বিছানা ছিল ঘাস এবং ছাই দিয়ে বানানো। তার সাথে যেই ধরনের গাছ-গাছালির পোকা তাড়ানোর ঔষধি গুণাবলি ছিল, সেগুলো ব্যবহার করে বিছানা বানানো হতো। ঘাসের বদলে খড় দিয়ে বিছানা বানানোর নমুনাও পাওয়া গেছে অনেক জায়গায়। আর বর্তমান বিছানা গুলো তৈরী সেই সূত্র ধরে, এবং দিন দিন সেরা বিছানা ডিজাইন গুলো আমাদের সামনে রয়েছে।
আলমারির জন্ম ইংল্যান্ডে
‘ওয়ার্ডরোব” শব্দটির আদি রূপ হচ্ছে ‘ওয়ার্ডারোব’। পুরোনো ইংরেজিতে “ওয়ার্ডার” শব্দটির মানে পাহারা দেওয়া। এবং রোব শব্দটি মূলত জামাকাপড়কেই বুঝিয়ে থাকে। সুতরাং, আলমারি কিংবা ওয়ার্ডরোব হচ্ছে সেই বস্তু, যা আপনার জামাকাপড় নিরাপদে রাখবে। আলমারি প্রথম ১৪ শতকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। ইংল্যান্ডের রাজপ্রাসাদগুলোতে রাজপরিবারের সদস্যদের পোশাক গুছিয়ে রাখতে আলমারির ব্যবহার শুরু হয়। তবে শুরুতে আলমারি একদমই ভিন্ন ছিল। তখন মূলত রাজপ্রাসাদের যেকোনো একটি রুমকে আলমারি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
আধুনিক আলমারির যেই চেহারা আমরা দেখি, তা প্রথম উনিশ শতকে দেখা যায়। ব্রিটিশ ফার্নিচার কোম্পানিগুলো কাঠের আলমারি বানানো শুরু করে। জায়গা বাঁচাতে তখন সেসব আলমারিতে স্লাইডিং দরজা দেখা যেত। বর্তমানে আলমারির সেরা ডিজাইন গুলো বাংলাদেশে সর্বরাহযোগ্য।
কাঠের ফার্নিচারে প্রকৃতির ছোঁয়া
আগে মানুষ প্রকৃতির মধ্যেই বসবাস করত। মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ততই তারা প্রকৃতির থেকে আলাদা হয়ে উঠেছে। অনেক নৃবিজ্ঞানীর মতে, প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গিয়েছে বলেই মানুষ প্রথম কাঠের ফার্নিচার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। কাঠের মধ্য দিয়ে ঘরের মাঝেই যেন প্রকৃতির ছোঁয়া খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছে তারা।
তবে কাঠের ফার্নিচারের ব্যাপক ব্যবহার শুরু মূলত এর উপযোগিতার কারণে। ধাতুর আসবাবের তুলনায় এগুলো অনেক হালকা এবং সহজেই বানানো যেত। তাই শিল্পবিপ্লবের পর বিশ্বজুড়ে ফার্নিচার কোম্পানি গুলো কাঠের ফার্নিচার বানানোর দিকে মন দেয়।
আসবাবপত্রের বিবর্তন আসলে সময়ের সাথে মানুষের জীবনযাপনের বিবর্তনকেই নির্দেশ করে। আসবাবের ইতিহাস সম্পর্কে নানা গল্প আপনার কেমন লেগেছে, তা এখনই কমেন্টে জানিয়ে দিন আমাদের।