অন্দরসজ্জায় বৈপরীত্য

ইকরি ও মিকরি দুই বোন। দুজনের মাঝে বয়সের তফাত খুব বেশি না। তাই বলেই হয়তো তাদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। ইকরির পাহাড় পছন্দ, তো আরেক দিকে মিকরির প্রিয় সমুদ্র। আবার শান্ত স্বভাবের ইকরির ভালো লাগে বই পড়তে আর চঞ্চল মিকরি ভালোবাসে ছবি আঁকতে। তাদের নিজেদের ঘরটিতেও দুজনের এই মিল-অমিলের ছাপ পড়েছে। মিকরির কথায় তাদের ঘরের একদিকের দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে গাঢ় নেভি ব্লু, আবার অন্যদিকে দেখা যায় ইকরির পছন্দের হালকা হলুদ রং। তেমনি ঘরের কোণের শোকেস ইকরি সাজিয়েছে মাটির তৈরি শিল্প দিয়ে, যেখানে মিকরি রেখেছে বেশি কিছু কাচের শোপিস। সবকিছুই যেন একটি অপরটির বিপরীত। আর এত সব মিল-অমিলই যেন ঘরের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঘরে সামঞ্জস্য তৈরিতে কন্ট্রাস্টের ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ

ইকরি-মিকরির এই গল্পের মাঝে একটি বিষয় স্পষ্ট। তারা একে অন্যের যতই বিপরীত হোক না কেন, এই মিল-অমিলগুলোই তাদের পরিপূর্ণ করে তুলছে। গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিষয়টি একই রকম, যাকে আমরা কন্ট্রাস্ট বা বৈপরীত্য বলে থাকি। দেয়ালে গাঢ় রং ব্যবহার করলে, বিছানার চাদর হওয়া চাই হালকা কোনো রঙের। কিংবা কাঠের চেয়ার কিংবা সোফার সঙ্গে ভেলভেট কাপড়ের কুশন। এই মিল-অমিলের খেলাই হচ্ছে কন্ট্রাস্ট বা বৈপরীত্য। গৃহসজ্জায় এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাদামাটা জীবনকে রঙিন ও আনন্দময় করে তুলতে গৃহসজ্জায় বৈপরীত্য আনার জুড়ি নেই। ঘরকে নিজের মতো সাজিয়ে তোলার আগে প্রত্যেকের এ বিষয় সম্পর্কে সঠিন ধারণা নেওয়া বেশ জরুরি। গৃহসজ্জার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে কন্ট্রাস্টকে ব্যবহার করে ঘরকে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেগুলো সম্পর্কে :

 

রং

অন্দরসজ্জায় বৈপরীত্য আনতে চাইলে সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে রং। একই সঙ্গে গাঢ় ও হালকা রঙের ব্যবহার ঘরকে সহজেই আকর্ষণীয় রূপ দিতে পারে। সাদা-কালো রঙের কথাই ধরা যাক। ঘরের দেয়াল সাদা হলে ফার্নিচার ও অন্দরসজ্জার সামগ্রীতে কালো বা গাঢ় রঙের ব্যবহার ঘরকে নান্দনিক করে তুলবে। আবার বসার ঘরের পর্দা যদি হয় গাঢ় নীল, তাহলে সোফা হওয়া চাই কমলা কিংবা হালকা হলুদের মতো উজ্জ্বল কোনো রঙের। এমন সব হালকা ও গাঢ় রঙের সংমিশ্রণ হাই-কন্ট্রাস্ট তৈরি করে, যা সহজেই ঘরকে আমাদের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলে। মূলকথা হচ্ছে, কন্ট্রাস্টিংয়ের জন্য এমন দুটি রং বাছাই করুন, যা একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে। একটি যদি হয় চোখধাঁধানো কোনো রং, অন্যটি হওয়া চাই নমনীয়। ফলে দুইয়ের মাঝে সামঞ্জস্যের কারণে সৃষ্টি হবে দারুণ কন্ট্রাস্ট! রং দিয়ে কন্ট্রাস্টের এই খেলা গৃহসজ্জায় বেশ জনপ্রিয়।  Citron-250 ঠিক এমন একটি সোফা। এর উজ্জ্বল টেরাকোটা রং যেকোনো গাঢ় রঙের দেয়ালের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যাবে।

একই সঙ্গে উজ্জ্বল ও মলিন রঙের ব্যবহার দারুণ কন্ট্রাস্ট তৈরি করবে

 

টেক্সচার

উঁচু, নিচু, চকচকে, মসৃণ, রুক্ষ, এমন টেক্সচারগুলোকে আমাদের মস্তিষ্ক সহজেই অনুধাবন করতে পারে। আর এর প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় আমাদের গৃহসজ্জায়। ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে টেক্সচার না ব্যবহার করার ফলে আমাদের চোখে ঘর দেখতে অনেকটা মলিন মনে হয়। অন্যদিকে টেক্সচার কন্ট্রাস্টিংয়ের মাধ্যমে তৈরি স্বল্প পরিবর্তনও গৃহসজ্জায় যোগ করতে পারে ভিন্নমাত্রা। একবার ভেবে দেখুন তো ঘরের কোণের কাঠের চেয়ারটির ওপর রাখা আছে ভেলভেট কাপড়ের বড় কুশন, কিংবা ফ্লোরে আঁকাবাঁকা ডিজাইনের টাইলসের ওপর সাজানো আছে চকচকে ও মসৃণ সব ফার্নিচার। দেখেই যেন চোখ জুড়িয়ে যাবে! অন্দরসজ্জায় টেক্সচারের মাধ্যমে কন্ট্রাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে রুক্ষ ও মসৃণ এই দুইকে বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়।

ভিন্ন রকম টেক্সচারের ব্যবহার ঘরের শোভা বাড়াবে

 

আকার-আকৃতি

কন্ট্রাস্টিংয়ে টেক্সচারের মতো আকার-আকৃতিও বড় ভূমিকা পালন করে। ঘরে বিভিন্ন আকার ও আকৃতির জিনিস আমাদের চোখকে স্বস্তি দেয়। বিভিন্ন আকারের জিনিসপত্রের সঠিক সামঞ্জস্য ঘরের শোভা বর্ধন করে বহুগুণে। যেমন, আমাদের ঘরের বেশির ভাগ আসবাব চারকোনা কিংবা আয়তাকার হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে ঘরের আয়নাটি যদি হয় গোলাকৃতির তাহলে ঘরের রূপে ভিন্নতা আসবে। আবার ইকরি-মিকরির গল্পের কাচের ও মাটির শিল্প দিয়ে শোকেস সজ্জাও কিন্তু ঠিক এমন একটি কন্ট্রাস্টের উদাহরণ। 

Importance of a Statement Piece in the Decor of a Roomগৃহসজ্জার সামগ্রীর আকার-আকৃতিতে থাকা চাই ভিন্নতা 

 

আভিজাত্য ও সাধারণের সংমিশ্রণ

ঘরকে শৈল্পিক ছোঁয়া দিতে অন্দরসজ্জায় এমন কন্ট্রাস্টিংয়ের জুড়ি নেই। গৃহসজ্জা মানেই ঘরকে আভিজাতিক রূপ দেওয়া, এমনটা আগে মনে করা হলেও এখন এই ধারণা পাল্টেছে। তাই অনেকেই এখন আভিজাত্য ও সাধারণ সজ্জাসামগ্রীর মাঝে সামঞ্জস্যের মাধ্যমে গৃহসজ্জার বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাধারণ সাদামাটা ডিজাইনের কোনো সোফার সঙ্গে সিল্কের কুশনের ব্যবহার, আবার ভেলভেট কাপড়ের চাদরের সঙ্গে পাট ফেব্রিক দিয়ে তৈরি বালিশের কভার বেশ মানিয়ে যাবে। সচরাচর এমন কন্ট্রাস্টিংয়ের ব্যবহার দেখা না । ফলে এটি সহজেই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আপনার ঘরকে কন্ট্রাস্টিংয়ের মাধ্যমে সাজিয়ে তুলতে এর চেয়ে সুন্দর উপায় আর আছে কি না, একবার ভেবে দেখুন তো!

আভিজাত্য ও সাধারণের সংমিশ্রণ তৈরি করবে দারুণ কন্ট্রাস্ট

 

আসবাবে ভিন্নতা  

গৃহসজ্জার একটি মূল উপাদান হলো ফার্নিচার। ঘর কতটা পরিপাটি ও সুন্দর দেখাচ্ছে, তা অনেকটাই নির্ভর করে সেখানের ফার্নিচারের ওপর। রং, টেক্সচার ছাড়াও ফার্নিচারের মাধ্যমেও যে কন্ট্রাস্টিং সম্ভব, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আগে বলেছি ঘরে সব ফার্নিচার ও সামগ্রী যদি একই ধাঁচের হয় তাহলে ঘরটি আমাদের চোখে মলিন হয়ে ওঠে। এ জন্য ঘরে প্রয়োজন কন্ট্রাস্ট ব্যবহার। ফার্নিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আকার ও রঙের আসবাবের ব্যবহার ঘরকে রূপে পরিবর্তন আনবে। কাঠ কিংবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ফার্নিচারের সঙ্গে ক্রোম ও স্টিলের মতো মেটালগুলো একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে  কাজ করে। শুধু যে ম্যাটেরিয়াল তা-ই নয়। ভিন্নধর্মী প্যাটার্নের আসবাবও এমন কন্ট্রাস্ট তৈরি করতে সক্ষম। হাতিলেও এমন ভিন্নধর্মী বেশ কিছু ফার্নিচার রয়েছে। Mississippi-109 Crosby-101 ভিন্ন গঠনের ঠিক এমন কিছু ফার্নিচার।

ভিন্ন কাঠামোর ফার্নিচারের মাধ্যমে তৈরি হবে অসাধারণ কন্ট্রাস্ট

 

হরেক মানের সজ্জাসামগ্রী

গৃহসজ্জায় সব সময় দামি কিংবা ভালো মানের সামগ্রী ব্যবহার করা চাই, এমন ধারণা ভুল। অন্দরসজ্জা হওয়া চাই আনন্দের, তার সামগ্রী যেমনই হোক না কেন! ইকরি-মিকরির গল্পে ফিরে যাওয়া যাক। ইকরি মেলায় যেতে ভালোবাসে। মেলায় গেলেই সেখান থেকে সে ঘর সাজানোর নানান জিনিস কিনে আনে। তারপর সেগুলো দিয়ে ঘর সাজায়। এই তো সেদিন সে মেলা থেকে কয়েকটি টেপা পুতুল কিনে এনেছে। সেগুলো আবার সাজিয়ে রেখেছে বাবার দেওয়া সাদা মার্বেলের ফুলদানিটির পাশে।    

গৃহসজ্জায় দাম নয় বরং সৌন্দর্যই মুখ্য বিষয় 

গৃহসজ্জার মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে কন্ট্রাস্ট একটি। এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ঘরের সৌন্দর্য বর্ধন করা। কন্ট্রাস্টের মাধ্যমে কত সহজেই যেকোনো ঘরকে অসাধারণ ও নান্দনিক রূপ দেওয়া সম্ভব, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে আর দেরি কেন? আজই কন্ট্রাস্টের ব্যবহারে আজই বদলে ফেলুন নিজের ঘরটিকে!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।